নাম না জানা পাহাড়ে

মনটা আবার ঘুরু ঘুরু করছিলো, ভাবলাম মার্চের শেষে পুরুলিয়া যাবো। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস, নির্বাচন কমিশন ভোট ঘোষণা করে দিলো। নাহ, যাওয়া যাবে না আর। ভোটের বাজার, কখন কি যে হয়, কে জানে? তাই গাড়িটা আজ পুরুলিয়ার বদলে ঘোরালাম উড়িষ্যার বালেশ্বরের দিকে।

হটাৎ করেই ঠিক করে ফেললাম এবারের গন্তব্য, সেটা উড়িষ্যার চাঁদিপুর। কিন্তু শুধু চাঁদিপুর গেলে তো হবে না, সাথে থাকুক পঞ্চলিঙ্গেশ্বর। চাঁদিপুর আর পাঞ্চলিঙ্গেশ্বর নিয়ে আপনাদের নতুন করে কিছু বলার নেই। অনেকেরই হয়তো ঘোরা এই সমুদ্রসৈকত আর শৈবতীর্থ। না ঘোরা থাকলে গুগলে একটু খুঁজে নিন, লাখ লাখ ভিডিও আর গল্প পেয়ে যাবেন। তাই আজ চাঁদিপুর আর পঞ্চলিঙ্গেশ্বর বাদ, আজ বলবো এমন এক জায়গার গল্প, যা এখনো ভ্রমণপিপাসু লোকচক্ষুর আড়ালে।

কলকাতা থেকে দূরত্ব: ২৮৬ কিলোমিটার

নিকটবর্তী রেলওয়ে স্টেশন: বালেশ্বর রেলওয়ে স্টেশন

সকাল ৭:৩০ নাগাদ যাত্রা শুরু করলাম, কোলাঘাট ব্রেকফাস্ট সেরে এগোতে লাগলাম বালেশ্বরের দিকে। খড়গপুর পার করতেই নাকা চেকিং, ভোটের বাজার, এসব তো থাকবেই। যাই হোক এরপর বেলদাতে এক বাল্যবন্ধুর বাড়িতে ঘুরে যাত্রা শুরু করলাম পাঞ্চলিঙ্গেশ্বর অভিমুখে। কলকাতা থেকে বালেশ্বরের রাস্তা ড্রাইভের জন্যে বেশ ভালো, যারা লং ড্রাইভ ভালোবাসেন তারা এই রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে খুব আনন্দ পাবেন। গিন্নি আর ছেলেদের সাথে গল্প করতে করতে আর ফোনে ডিরেক্শন দেখা হয়নি, তাই কখন যে বালেশ্বর পেরিয়ে গেছি বুঝতে পারিনি। সম্বিৎ ফিরলো, শেরগড় টোল প্লাজার সামনে। আরে, এই টোল তো আমাদের লিস্টে ছিল না। অগত্যা গুগল ম্যাপ খুললাম। যাক, আর ১৫ কিলোমিটার গিয়ে ডানদিকে ঘুরলেই আর ৩০ কিলোমিটার। তাহলে যাওয়া যাক।

মুরুগুমা যাওয়ার পর থেকে গ্রামের রাস্তায় এখন আর গুগলকে ভরসা করতে পারিনা, তাই পিতলপাড়ার রাস্তায় ঢুকে লোকজনকে জিজ্ঞাসা করতে করতে এগোতে লাগলাম পঞ্চলিঙ্গেশ্বেরের দিকে। গ্রামের পথ দিয়ে বাউলাগাড়িয়ার রাস্তায় একটু চা খেতে দাঁড়ালাম, আর এই চা খেতে দাঁড়ানোটাই আমাদের এই সপ্তাহান্তের ভ্রমণকে আরো আকর্ষনীয় করে তুলেছিল।

প্রথম দর্শনে সুখা পাহাড়

প্রতিবারের মতো, এবার চা খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলাম, এখানে পঞ্চলিঙ্গেশ্বর ছাড়া আর কি কি দেখার আছে? লোকাল লোকজন বলল, খুমকুট ড্যাম আছে আর সুখা পাহাড়। বিকেল হয়ে এসেছে, হাতে সময় কম, তাই ঠিক করলাম সুখা পাহাড় যাবো। দেখি কেমন? এক আদিবাসী গ্রামের মধ্যে দিয়ে সংকীর্ণ পথ পেরিয়ে পৌঁছলাম সুখা পাহাড়। মোহিত হয়ে গেলাম।

ভারতবর্ষের প্রত্যেক কোনায় এই রকম অনেক জায়গা লুকিয়ে আছে, যেগুলো এখনো আনেক্সপ্লোরেড। কি অসাধারণ জায়গা। পাহাড়ের ঠিক পাদদেশে আছে বিশ্বেশ্বর শিব মন্দির আর তার পেছন থেকে উঠেছে এই রেঞ্জ।

স্থানীয় লোকেদের কাছে জানলাম, জায়গাটা বিখ্যাত কুলডিহা অভয়ারণ্যের একেবারে পিছনের দিক। আমার দেখে যা মনে হলো, ছোট বড় আগ্নেয় শিলা দিয়ে তৈরী এই রেঞ্জ। পাঞ্চলিঙ্গেশ্বরের পাহাড়টিও এই রেঞ্জের মধ্যে পড়ে বলেই আমার বিশ্বাস।

পাহাড়ের গা বেয়ে ছোট বড় পাথর পেরিয়ে চলে যেতে পারেন অনেকটাই। আমি তো বেশ অনেকখানি গিয়েছিলাম। প্রতিটা বাঁকে অবাক করে দেওয়া সৌন্দর্য। সামনে ধু ধু করছে প্রান্তর, তার সামনে এই পাহাড়। দারুন লাগে দেখতে।

কোনোদিন পঞ্চলিঙ্গেশ্বর বেড়াতে আসলে এই জায়গাটা মিস করবেন না। গুগলে বিশ্বেশ্বর মহাদেব টেম্পল, বাউলাগাড়িয়া, ওড়িশা নেভিগেট করে একবার ঘুরে যান। নিরাশ হবেন না।

এই জায়গাতে থাকার কোনো ব্যবস্থা নেই, থাকতে চাইলে পঞ্চলিঙ্গেশ্বরে থাকুন আর বিকেলে ঘুরে যান ৯ কিলোমিটার দূরের সুখা পাহাড়। আমরা প্রায় ঘন্টাখানেক ট্রেক করেছিলাম, সন্ধ্যা নেমে আসাতে আর এগানো হয়নি। কিন্তু পাহাড়টা দেখে আমার কেমন যেন মনে হচ্ছিলো, যদি রোগা থাকতাম তবে, পুরো রেঞ্জটাই হেটে চড়ে এক্সপ্লোর করে ফেলতে পারতাম।

যদি খুঁজে পাওয়া যেত একটা ঘর

তাই বলি কোনোদিন যদি চাঁদিপুর বা পঞ্চলিঙ্গেশ্বর আসা হয় তবে কলকাতা থেকে ঘন্টা পাঁচেক দূরে ওড়িশার হিডেন জেম সুখা পাহাড় দেখতে ভুলবেন না।