রিক্সা সওয়ারীর ডায়েরি

পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের দামামা বেজে গেছে, তাই হটাৎ করে আজ ১০ বছর আগের ডায়েরির পাতায় চোখ বোলালাম। যেহেতু ২০২১ এর নির্বাচনের প্রাক্কালে এক দশক আগের নির্বাচন পরবর্তী ভ্রমণের গল্প বলবো, তাই লাল,নীল,সবুজ, হলুদ থুড়ি গেরুয়া রঙে রাঙিয়ে নেবো ডায়েরির পাতাটা। ভালো কথা, গল্পটা পড়ে কেমন লাগলো তার কমেন্ট দেবেন, কেস দেবেন না প্লিস।
বছর দশেক আগে নির্বাচনের ফল বেড়ানোর ঠিক পরপরই ছেলেবেলার চার বন্ধু (গৌতম, দিপু, বাপ্পা আর আমি) মিলে বেরিয়ে পড়েছিলাম বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার দিকে। হাতে সময় ছিল ঠিক দেড়দিন আর গন্তব্য ছিল আদ্রার জয়চন্ডী পাহাড় আর মন্দিরনগরী বিষ্ণুপুর। কিন্তু আজ ডায়েরির যে পাতাটা উল্টাবো, সেটা আমাদের শিডিউলে ছিল না, মানে তখন জানতামই না এমনও একটা জায়গাতে আমরা বিষ্ণুপুর থেকে কলকাতা ফেরার পথে যেতে পারি। তাই আর বেশি না বকে শুরু করি আমার রিক্সা সওয়ারীর ডায়েরি।

বিষ্ণুপুরের সকালটা ঠিকঠাক ভাবেই শুরু হয়েছিলো। সকালে প্রাতঃরাশ সেরে রওনা দিয়েছিলাম কলকাতার উদ্দেশ্যে। ঠিক ছিল, লোকাল ধরে যাবো খড়্গপুর, তারপর হাওড়া হয়ে বাড়ি। সেইমতো ট্রেনেও উঠে পড়লাম। একি, ট্রেনে তো বেশ ভিড়। শিয়ালদহ মেন্ লাইনের ডেইলি প্যাসেঞ্জার হওয়ার গর্বে গর্বিত হয়ে বলে বসলাম, “এ আর কি ভিড়! এমনি পৌঁছে যাবো খড়্গপুর”। তখন টুইটারের প্রচলন না থাকলেও আমার বিশ্বাস, আমার এই উক্তি হয়তো তৎকালীন কোনো রেলকর্তার কানে পৌঁছেছিল। নাহলে, বিষ্ণুপুরের পরের স্টেশন পিয়ারডোবা থেকে কাতারে কাতারে এতো লোক ওঠে কিভাবে ট্রেনে। নিশ্চয়ই বিরোধীদের ষড়যন্ত্র। নাহ, আর ট্রেনের কামরায় থেকে ট্রেন চড়া যাচ্ছে না। দূর ছাই বলে নেমে গেলাম পরের স্টেশন গড়বেতায়। উফ, যেন হাফ ছেড়ে বাচলাম, পরের ট্রেনে যাবো খড়্গপুর।
কলকাতা থেকে দূরত্ব: ১৩৬ কিলোমিটার
নিকটবর্তী রেলওয়ে স্টেশন: গড়বেতা রেলওয়ে স্টেশন
ঘড়িতে তখন ১০টা, গড়বেতাতে চরম গরম। রোদ্দুরের তাপটা চরাম চরাম করে গায়ে পড়ছে, প্রায় ৪০ ডিগ্রি। এবার গলাটা একটু ভেজাতে হবে…ওই…ওই তো চায়ের দোকান। যাই, গিয়ে চায়ে পে চর্চা করি। বাঙালী যেখানেই যাক, চায়ের দোকান ঠিক খুঁজে নেয়।
চা খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলাম,”পরের ট্রেন কটায়?” উত্তর এলো ”আর চার ঘন্টা পরে”। শুনে আশার মুকুলগুলো যেন কোনো এক বাজারের ব্রিজের মতো হুড়মুড়িয়ে খসে পড়লো।, এটা উত্তর ছিল না আমফান? চারমূর্তি একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলাম। আর মনে মনে বলতে লাগলাম, “তাহলে কি আমরা বাড়ি যাবো না, যাবো না আমরা বাড়ি?”
আমাদের এই অলীক ভাবনার মাঝে হটাৎই মাসিহার মতো আবির্ভাব হলেন একজন। তিনি বললেন, “এখানে এতক্ষন বসে কি করবেন? তার চেয়ে সাইকেল-রিক্সা করে গড়বেতার চারপাশ ঘুরে আসুন”। মন্দ বলেননি কাকা। গড়বেতাতে দেখার কিছু থাকুক কি না থাকুক, চারপাশটা ঘুরে আসলে চার ঘন্টা গালে হাত দিয়ে বসে থাকতে হবে না। তারপর আর বেশি কিছু করতে হয়নি, ওই ভদ্রলোকই ডেকে দিলেন দুই সাইকেল-রিক্সার সারথিকে। শুরু হলো আমাদের সাইকেল-রিক্সা ডায়েরি।
কোথায় থাকবেন: গড়বেতাতে দু-একটা সাধারণ মানের হোটেল পাবেন, কিন্তু ভালোমতো থাকতে গেলে বিষ্ণুপুরে থাকুন
প্রসঙ্গত বলে রাখি, আমি এখন গায়ে গতরে যতখানি, তখনও তেমনি ছিলাম। তাই, আমার রিক্সার সারথীর প্যাডেল একবার ঘোরাতে প্রায় ২ মিনিট সময় লাগছিলো। কিছুটা চলার পর বলেই ফেললাম, “ভাই, এই উঁচুটাতে একটু কি নেমে যাবো?” প্রস্তাব গৃহীত হল, নামলাম রিক্সা থেকে। উঁচু জায়গাটাও পেরিয়ে গেলাম, কিন্তু সারথি ভাই আমায় আর রিক্সাতে তুলছে না, আমিও হাটছি…রিক্সাও হাটছে। যেন দুই সর্বহারার মেলবন্ধন। বেশ কিছুক্ষন হাঁটার পর বললাম, “এবার কি উঠবো?”
উত্তর এলো, “হ্যা দাদা, উঠুন। এবার রাস্তা প্লেন আছে”। আপনারাই বলুন, এভাবে কি বলা উচিৎ। যদিও এতটাও মোটা আমি নই যে, রিক্সাসারথী আমায় টানতে পারবে না। এটা অবশ্য সম্পূর্ণ আমার ভাবনা। যাই হোক, প্রথম গন্তব্য গড়বেতা শ্যাম মন্দির।



মিনিট দশেক চলার পর এলো শ্যাম মন্দির। বেশ বড় কমপ্লেক্স, মন্দিরের সাথে আছে একটা কম্যূনিটি হল। আর সবচেয়ে ইম্পরট্যান্ট, একটা ঠান্ডা পানীয় জলের স্টোরেজ। কোনোদিন গড়বেতার শ্যাম মন্দিরে এলে, বোতলে ঠান্ডা জল ভরতে ভুলবেন না। যা গরম ওয়েদার, এই ঠান্ডা জল না পেলে আরো কষ্ট হতো। আমার তখনকার মোবাইলের ভেজা ক্যামেরায় (VGA Camera) তোলা কিছু ছবি দিলাম। এরপরের বার যখন যাবো তখন আইফোনে ছবি তুলে দেখাবো। আর হ্যা, আমার আইফোন কেনার টাকা জোগাড়ের জন্যে কিন্তু বিজ্ঞাপনে টুকুস করে টোকা দিতে ভুলবেন না।
মন্দির ভ্রমণ সাঙ্গ করে আবার চেপে বসলাম রিক্সাতে। সামনেই গড়বেতা কলেজ, আর তার প্রায় উল্টোদিকে সুরুচি রেস্তোরাঁ। হাতে মেলা সময়, তাই একটু পেটপূজা সেরে নিলে মন্দ হয় না। পাত পেড়ে খেলাম ডিম্-ভাত। আর তারপর, যাবো কোথায়?
যাবো সেই অচিনপুরে, যার নাম গনগনি
দ্য গ্রান্ড ক্যানিয়ন অফ বেঙ্গল
রিক্সা নিয়ে বেশ কিছুদূর এগিয়ে, ইনডেন গ্যাস অফিস পেরিয়ে বাম হাতের লাল মেঠো রাস্তা ধরলাম। এই গনগনি কিন্তু আজকের গনগনি নয়, সে তখন নবীনা ও লাস্যময়ী। ছোট ছোট গাছে ভরা জঙ্গলের বুক চিরে, আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে এগোতেই চোখে পড়লো, বেশ অনেকখানি একতাল কালো মাটির তালের মতন কিছু। কৌতূহলবশত সারথীকে জিগাইলাম, “এইডা কি?” জবাব এলো, “হাতির ল্যাড়”।
হাতির ল্যাড়!!! মানে হাতির হাগু। আবার ধোঁয়াও উঠছে! জিজ্ঞেস করলাম, “এখানে হাতি আছে নাকি?” সারথী বললো, কাল রাতেই নাকি এই রাস্তা দিয়ে গোটা ৩০-৩৫ হাতি গেছে। এই মেরেছে। এমনিতে সকালে বেরানোর সময় ডিওডরেন্ট দিইনি, এবার যদি গন্ধ শুকে গজাননেরা কাছে এসে বলে,”খেলা হবে” তাহলে তো কেস জন্ডিস। জলদি চলো ভাই, জলদি।



কিছুটা এগোতেই দেখতে পেলাম মোহময়ী গনগনিকে। প্রথমা দর্শনেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম শিলাবতী নদীসৃষ্ট গর্জকে দেখে, ”বাহ্” ছাড়া কোনো শব্দ বেরোয়নি মুখ থেকে। অবাক দৃষ্টিতে বেশ কিচ্ছুক্ষন চেয়ে রইলাম সোনার বাংলার সোনাঝরা রূপমূর্ছানার দিকে।
ভৌগোলিকভাবে দেখতে গেলে, গনগনিকে গিরিখাত বা গর্জ বলা যায়না। সচরাচর দক্ষিণবঙ্গে আমরা এমন জিনিস দেখতে পাইনা বলে, যা পাই তাকেই মোটামুটিভাবে বৃহৎ বলে ধরে নিই। গনগনিও তার ব্যতিক্রম নয়। যদি আরিজোনার গ্রান্ড ক্যানিয়নের সাথে এর তুলনা টানি, সেটা বাতুলতা বললে কম বলা হবে। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই, গ্রান্ড ক্যানিয়ন ৪৪৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যে, ২৯ কিলোমিটার চওড়ায় আর ১৮৫৭ মিটার উচ্চতায়। আর আমাদের গনগনি সেখানে দৈর্ঘ্যে খুব বেশি হলে ২-৩ কিলোমিটার।
গনগনিকে আমরা রিল ক্ষয় বা নালা ক্ষয় (Rill and Gully Erosion) বলতে পারি। আচ্ছা, এবার একটু ভূগোল পড়াই। গনগনি এলে দেখবেন, শিলাবতী নদীর একধার প্রায় ৭০-৮০ ফিট উঁচু, আর অপরদিক সমতল। এটি আসলে প্রাকৃতিক ভূমিক্ষয়ের একটি রূপ। যখন বৃষ্টির জল কোন উঁচু জায়গা থেকে নিচের দিকে প্রবাহিত হয়, তখন জমির উপরের অংশের অপেক্ষাকৃত নরম অংশ ধুয়ে যেতে থাকে বা তার ক্ষয় হতে থাকে। এইভাবে বছরের পর বছর চলতে চলতে জমির উপরের অংশের ঢাল বরাবর লম্বাকৃতি রেখার সৃষ্টি হতে থাকে, এটা রিল ক্ষয়। এর পরের ধাপ নালা বা গালি ক্ষয়, দীর্ঘকাল ধরে রিল ভূমিক্ষয়ের ফলে এর লম্বাকৃতি রেখাগুলো বড় হতে থাকে এবং ক্রমশ বিভিন্ন রূপ নেয়। কখনো এদের নর্দমা বা ছোট নদীর মত দেখায় আবার কখনো দেখায় বিভিন্ন রকম আকৃতিতে। নিচে গনগনির কয়েকটা ছবি দিলাম, আশাকরি ব্যাপারটা ধরতে পারবেন।
এই মুহূর্তে গনগনি ভূমিক্ষয়ের দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপের মাঝামাঝি আছে। এরপর আছে শেষ ধাপ, যাকে বলে ভাঙ্গন। কালের নিয়মে একদিন এই গনগনি বিলীন হবে শিলাবতীতে। আমরা যদি সচেতন হই আর ওই অঞ্চলে বৃক্ষছেদন রোধ করতে পারি, তবে ভূমিক্ষয়ের অন্তিম ধাপকে আমরা বিলম্বিত করে দিতেই পারি। অনেক ভৌগোলিক জ্ঞান দিলাম, আবার ভ্রমনের ডায়েরিটা পড়া শুরু করি।
কোথায় ছিলাম যেন? ও হ্যা, গনগনি পৌঁছানোর পর আমাদের সারথী বিশু আমাদের আস্বস্ত করলো যে, হাতি সিঁড়ি দিয়ে নামতে পারেনা। ব্যাস, আর কি বীরের মতো নামতে শুরু করলাম পাথুরে সিঁড়ি দিয়ে শিলাবতীর দিকে। এখন পাঁকা সিঁড়ি হয়েছে বলে শুনেছি, কিন্তু আমরা যখন গিয়েছিলাম তখন ছিল লাল পাথুরে সিঁড়ি।
সিঁড়ি দিয়ে নেমেই লক্ষ্য করলাম, বিভিন্ন চ্যানেল দিয়ে ছোট ছোট স্ট্রিম নদীর দিকে আসছে। এক এক করে আমরা স্টিম বা চ্যানেলগুলো ধরে হাটতে লাগলাম। পায়ে পায়ে বিস্ময় আর প্রতি বাঁকে চমক। আর তা তৈরী করে চলেছে আমাদের প্রকৃতি।
ভূমিক্ষয় বিভিন্ন ধরনের শেপ তৈরি করেছে, সেগুলোর কোনটা লাগে মুক্তমঞ্চের মতো, কোনটা মন্দিরের মতো, কোনটা গুহাদ্বারের মতন। মন ভরে ছবি তুলুন এখানকার আর নিকটজনদের জানান যে এমনও এক জায়গা আমাদের বাংলাতে আছে। শান্তিনিকেতনেও ঠিক এইরকম দেখতে পাবেন, কিন্তু তার চেয়ে গনগনি বেশ অনেকটাই বড়।
কলকাতা থেকে বেশি দূর না, একদিনে গিয়েই ঘুরে আসতে পারেন। আর থাকার ইচ্ছে হলে, বিষ্ণুপুরে রাত্রিবাস করে বেরিয়ে আসুন গনগনি।
যাই হোক, আমাদের সারথীদের তত্ত্বাবধানে বেশ ভালোই ঘুরে সময়মতো ফিরে এসেছিলাম গড়বেতা স্টেশন। ভাবলাম, হায় গড়বেতা, তোমার কি জন্যে বিখ্যাত হওয়ার কথা ছিল আর হলে কি জন্যে? এখানেই শেষ হল আমার রিক্সা সওয়ারীর ডায়েরি। এবার যাই, টুম্পাকে নিয়ে বাদাম খাই।
Anindya Chakraborty
অনবদ্য লিখনশৈলী । অসাধারণ রসবোধ । আর তার সঙ্গে দক্ষ হাতে বর্ণনার সাবলীলতা । এই লেখা পড়লে গনগনিকে নিয়ে আগ্ৰহ জাগতে বাধ্য ।