ল্যাদ এবং ল্যাদ

করোনা আবহে অক্টোবর মাসটা ঘরে বসেই কাটছিলো। কি আর করা যাবে? চারদিকে যা অবস্থা। তবুও মন চাইছিলো কাছেপিঠে কোথাও টুক করে ঘুরে আসতে। প্রশ্ন হলো যাবো কোথায়? কাছাকাছি সবই প্রায় ঘোরা। নাহ, নতুন কোন জায়গাতে উইকেন্ডটা কাটিয়ে আসতে হবে। আর এই করোনাকালে ভ্রমণস্থান নির্বাচন যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং। এমন জায়গা বাছতে হবে, যেখানে খুব একটা জনসমাগম হয় না, কিন্তু একদিন নিভৃতে কাটানোর জন্যে আদর্শ। গুগল বাবার জয় বলে খোজ শুরু করলাম।

প্রচুর জায়গা খুঁজে অবশেষে পেলাম বামুনতোড়ের নাম, যেটা পারফেক্টলি ফিট করে এক অন্য অবসরযাপনের জন্যে। বামুনতোড়! অচেনা লাগছে কি জায়গাটা? চিন্তা নেই এবার চিনিয়ে দেবো।

আগের শনিবার সক্কাল সক্কাল ঘুম থেকে উঠে পরিবার নিয়ে রওনা দিলাম। আবার সেই দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে। প্রত্যেকবারের মতো আজাদ হিন্দ ধাবাতে ব্রেকফাস্ট সেরে সোজা দুর্গাপুর হয়ে রানীগঞ্জ। রানীগঞ্জ পর্যন্ত রাস্তা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই, পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম ভালো রাস্তা।

রানীগঞ্জ হয়ে মেজিয়া ব্রিজ ধরে দামোদর পেরিয়ে বাঁকুড়া জেলা ঢুকতেই ছোট বড় অনেক টিলাকে উঁকি মারতে দেখবেন। এখন থেকে সালতোড়া বি.এড কলেজ, বড় রাস্তার ডানপাশেই পড়বে এই কলেজ, গুগল মতে ওর পাশ দিয়েই যেতে হবে বামুনতোড়।

কলকাতা থেকে দূরত্ব: ২২৩ কিলোমিটার

নিকটবর্তী রেলওয়ে স্টেশন: মধুকুণ্ডা অথবা রানীগঞ্জ অথবা আসানসোল রেলওয়ে স্টেশন

সালতোড়া বি.এড কলেজের থেকে বামুনতোড় পর্যন্ত রাস্তা খুব একটা ভালো না, তবুও চলছিলাম। কিছুটা এগিয়ে দেখি রাস্তা বাঁশ দিয়ে আটকানো? কেস কি? গ্রামের একজন বললেন, লক্ষী পুজোর খাওয়া চলছে বলে রাস্তা বন্ধ। মাইরি, এমনও হয়। তাহলে উপায়? উপায় সেই মানুষটি বলে দিলেন, জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে রাস্তা আছে, ওখান থেকে গেলে নাকি সামনে পাকা রাস্তা পেয়ে যাবো। বেশ, তাই হোক তবে।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, জঙ্গলের মধ্যে কি রাস্তা ছিল? আমি তো দেখিনি। ইয়া বড় বড় পাথরে ভরা, আর গর্ত দেখলে মনে হবে কুয়ো খুঁড়ে রাখা আছে। আর এতো জনশুন্য এই জঙ্গলের রাস্তা, মনে হচ্ছিলো এই ডাকাত এসে সব কেড়েকুড়ে নিয়ে চলে যাবে। বিক্ষিপ্তভাবে থাকা পাহাড়গুলো দেখতে মনোরম, কিন্তু ড্রাইভিংয়ে নজর দিতে গিয়ে আর ছবি তোলা হয়ে ওঠেনি।

কোথায় থাকবেন: বিহারীনাথ ইকো ট্যুরিজম

যোগাযোগ: সরাসরি ফোন করুন ০৮২৫০১৬৫৭৬৫

এভাবেই চলতে লাগলাম, হটাৎ দেখি সামনে চার রাস্তার মোড়। আর আমাদের সামনে দিয়ে হুশ করে বেরিয়ে গেলো একটা মিনি বাস। ভাটের গুগল বাবা, এটা কি রাস্তা দিয়ে আমাদের আনলে বস। ভালো রাস্তা তো ছিল।

যাই হোক, অবশেষে চলে এসেছি বামুনতোড়, ২০০ মিটার বামদিকে গেলেই বিহারীনাথ পাহাড়ের পাদদেশে আমাদের আজকের গন্তব্য বিহারীনাথ ইকো ট্যুরিজম। এইখানে যে এমন একটা প্রপার্টি থাকতে পারে, সেটা এক কথায় ভাবা যায় না। বিহারীনাথ বাঁকুড়া জেলার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ থুড়ি টিলা। কাছাকাছি আরো তিনটে টিলা থাকলেও, নজর কাড়ে বিহারীনাথ। খুব খিদে পেয়ে গিয়েছিলো। চেক-ইন করে খাওয়ার অর্ডার দিয়ে দিলাম। ফ্রেশ হয়ে খেয়ে দেয়ে একটু ঘুমিয়ে নিতে হবে, বেশ ক্লান্ত লাগছে।

বিহারীনাথ ইকো ট্যুরিজমের ঘর থেকে

সপ্তাহান্তে ল্যাদ খাওয়ার অসাধারণ জায়গা বিহারীনাথ। এই হোটেলের সবকটা রুম থেকে দেখা যায় বিহারীনাথকে। বেশি কিছু করার নেই এখানে, ঘরে আয়েশ করে বসুন আর প্রাণ ভরে দেখুন সবুজে মোড়া বিহারীনাথকে। দিন আপনা আপনি কেটে যাবে।

একটু ঘুম দিয়ে বেরোলাম হোটেল কম্পাউন্ডে। একটু ঘুম দিয়ে বেরোলাম হোটেল কম্পাউন্ডে। বেশ আকর্ষণীয়। রংবেরঙের ফোয়ারা চারদিকে। এখানে চা আর পকোড়া সহযোগে দারুন লাগে সন্ধ্যেটা। এখানে এসে বেশি কিছু সত্যিই করার নেই, তাই বিহারীনাথ দেখুন, আর ল্যাদ খান। আমিও ল্যাদ খেয়েই কাটিয়েছিলাম দিনটা। বেশ লাগছিলো।

Biharinath
জানলা দিয়ে বিহারীনাথ

পরদিন সকালে জানলার পর্দা সরিয়েই দেখলাম দারুন বিহারীনাথকে। ছেলেকে নিয়ে চললাম পাহাড় চড়তে। হোটেল পেরিয়েই রাস্তা গেছে বিহারীনাথে ওঠার। বেশ যাচ্ছিলাম জঙ্গলের রাস্তা ধরে, তারপর পায়ের আঙুলে পিঁপড়ের এমন কারণ খেলাম যে বিকেল অবধি পা টনটন করেছিল। ব্যাস, আর ওঠা হল না পাহাড়ে। নেমে এলাম। এরপর একটু এপাশ ওপাশ ঘুরে ফিরে এলাম হোটেলে। তারপর আর কি, বাড়ি ফেরার জন্যে রেডি হতে লাগলাম।

আর হ্যা, রিসোর্টের পাশেই একটা সরকারি ইকো পার্ক আছে, ঘুরে আসতে পারেন। সাথে বাচ্চা থাকলে ওদের বেশ ভালোই লাগবে। ওখানেও থাকার সুব্যবস্থা আছে, ভাড়া খানিকটা কম। এই পার্কের পাশ থেকেই বিহারীনাথ ওঠার রাস্তা। নিচে কয়েকটা ছবি দিলাম, কেমন লাগলো জানাবেন। কারণ ছবিগুলো আমার বড় ছেলের তোলা, আপনাদের কমেন্টের জন্যে ও কিন্তু অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে।

উইকেন্ড শেষ, এবার বাড়ি ফিরতে হবে। রিসেপশনে গিয়ে ফেরার ঠিকঠাক রাস্তা জানলাম, কারণ গুগলের ওপর থেকে ভরসা উঠেই গিয়েছিলো। ফিরলাম ইতুরি, সালতোড়া হয়ে দুর্গাপুর হয়ে। বেশ ভালো রাস্তা। অনেক ধন্যবাদ বিহারীনাথ ইকো ট্যুরিজমের সবাইকে। আপনাদের সৌজন্যে খুব ভালো কাটলো আমাদের ছোট্ট উইকেন্ড ট্রিপ।

ফেরার সময় দুর্গাপুরে বেশ জ্যাম ছিল, কারণ ৩১ নম্বর লকগেট ভেঙে গিয়েছিলো। জলশূন্য ব্যারাজ খা খা করলেও মানুষজনের উৎসাহের কমতি ছিল না। শয়ে শয়ে মানুষজনকে দেখলাম মাছ ধরতে ব্যস্ত। যেন উৎসব হচ্ছে। আশা করবো খুব তাড়াতাড়ি সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

Durgapur Barrage
জলশূন্য দুর্গাপুর ব্যারাজ

বেশ ভালোই কেটেছিল বিহারীনাথের কোলে আমাদের ল্যাদযাপন। আপাতত বাড়িতেই থাকি, কদিন ল্যাদ খাই, তারপর ভাববো পরের ডেস্টিনেশন।