দৌড়ে গেলাম গৌড়ে

একে দৌড় ছাড়া আর কি বলবো। ১৫ই অগাস্ট ছিল শুক্রবার। শনি রবি ছুটি, একবার কোথাও ঘুরে আসলে মন্দ কি? তাই এক দৌড়ে চলে এলাম গৌড়, বাংলার মধ্যযুগীয় রাজধানী। দিল্লির মতো বারবার উত্থান আর পতনের সাক্ষী এই গৌড়।

অনেকে বলেন গৌড়ের উত্থান রামায়ণের লক্ষণের হাত ধরে। লখনাউতি নাম ছিল নাকি এই জায়গার। তবে তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে, অনেকে বলেন, এই নাম এসেছে লক্ষণ সেনের নামে। নাহ, আর বিতর্কে গেলাম না। তার চেয়ে বরং ভালো করে ঘুরে আসি।

কলকাতা থেকে দূরত্ব: ৩৩০ কিমি

নিকটবর্তী রেলওয়ে স্টেশন: মালদহ জংশন রেলওয়ে স্টেশন

আমরা ছিলাম রথবাড়ি মোড়ের পশ্চিমবঙ্গ পর্যটনের টুরিস্ট লজে, ওখান থেকে গৌড় খুব বেশি হলে ১৫ কিলোমিটার। সকাল সকাল একটু ব্রেকফাস্ট করে চললাম গৌড়ের উদ্দেশ্যে। পর্তুগিজ ইতিহাসবিদ ফারিয়া সৌসা অনেক গবেষণা করেছিলেন গৌড় নিয়ে। তার মতে প্রায় ১২ লক্ষ মানুষের বাস ছিল সুবিশাল প্রাচীর বেষ্টিত এই নগরীতে। তা যাই হোক, গৌড় দর্শন শুরু করলাম রামকেলি থেকে।

Ramkeli
রামকেলিতে চৈতন্যদেবের পদচিহ্ন

রামকেলিতে একটা ছোট মন্দির আছে, যেখানে পাথরের চৈতন্যদেবের পদচিহ্ন অঙ্কিত আছে। বেশ ছবি তুলছিলাম, তা দেখে স্থানীয় একজন এগিয়ে এসে বললেন, চৈতন্য নাকি নবদ্বীপ থেকে পুরী যাওয়ার সময় এই রাস্তা দিয়ে গিয়েছিলাম। শুনলাম, কিন্তু পাল্টা উত্তর দিলাম না। আসলে নবদ্বীপ থেকে পুরী যেতে মালদা আসার কি দরকার সেটা বুঝলাম না। হয়তো গুগল ম্যাপ ছিল না বলে এমন হয়েছিল নয়তো লোকটি, ক্যামেরা দেখে আপ্লুত হয়ে গিয়েছিলো। তবে আমি যতদূর শুনেছি, চৈতন্য বৃন্দাবন যাওয়ার সময় কয়েকদিন এখানে ছিলেন। এবার আমরা বরং যাই পরের ডেস্টিনেশন।

পরের ডেস্টিনেশন রাজ চক্রবর্তীর “বোঝে না সে বোঝে না” সিনেমার কল্যানে আজ সুবিখ্যাত। ধন্যবাদ রাজ দা, অন্যদের মতো লন্ডন, সিঙ্গাপুরে শুট না করে মালদাতে শুটিং করার জন্যে। গানটা দিয়ে দিলাম এখানে, জায়গাগুলো চিনতে সুবিধা হবে।

“কঠিন তোমাকে ছাড়া একদিন” – গানটা গৌড়ে শুট হয়েছিল

গৌড়ের ষ্টার এট্রাক্শন হল এই বারোদুয়ারী মসজিদ। কালের নিয়মে ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও এর আকর্ষণ একটুও কমেনি। গৌড়ের স্থাপত্য কীর্তিগুলির মধ্যে এটি সবথেকে বড়। ইট ও পাথর দিয়ে নির্মিত এই মসজিদ নির্মাণ শুরু করেছিলেন আলাউদ্দিন হুসেন শাহ এবং শেষ করেন তার পুত্র নাসিরুদ্দিন নুসরত শাহ। এর উচ্চতা ২০ ফুট, দৈর্ঘ্য ১৬৮ ফুট ও প্রস্থ ৭৬ ফুট। সংখ্যা দেখেই নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, কত বড় জায়গা জুড়ে ছিল এই স্থাপত্য। অতীতে ৪৪ টি গম্বুজ থাকলেও এখন মাত্র ১১ টি অবশিষ্ট।

ইন্দো-আরবী স্থাপত্যের এক অন্যতম নিদর্শন এটি। ১২টি প্রবেশদ্বার ছিল বলে এই মসজিদের নাম বারদুয়ারী। বর্তমানে তিন খিলানের মধ্যবর্তী করিডোরটাতে অবশিষ্ট গম্বুজগুলি বিদ্যমান।

বারোদুয়ারী দেখে আমাদের পরের গন্তব্য দাখিল দরওয়াজা অথবা সেলামী দরওয়াজা। নিউটাউনে কলকাতা গেট তৈরীর আগে পর্যন্ত, এটাই ছিল পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে বড় দরজা। ১৪২৫ খ্রিস্টাব্দে সুলতান বারাবক শাহের আমলে ২১ মিটার উঁচু আর সাড়ে ৩৪ মিটার দৈর্ঘ্যযুক্ত এই দরজা তৈরী হয়েছিল। এটি গৌড় দুর্গে প্রবেশের প্রধান দ্বার ছিল। কথিত আছে, এই দরজার দুপাশ থেকে তোপধ্বনি করে সুলতান ও উর্দ্ধতন রাজপুরুষদের সম্মান প্রদর্শন করা হত, তাই এই দরওয়াজার আর এক নাম সেলামী দরওয়াজা।

ফিরোজ মিনার

দাখিল দরজার থেকে একটু দূরেই অবস্থিত ফিরোজ মিনার। ২৬ মিটার উঁচু পাঁচতলা এই মিনারটি সাইফুদ্দিন ফিরোজ শাহ তৈরী করেছিলেন। তুঘলকি স্থাপত্য রীতিতে তৈরী এই মিনারে ওঠার পারমিশন নেই। তাই নিচে থেকেই দেখুন।

বাইশ গজী দেওয়াল

বাইশ গজী দেওয়াল এখন থেকে কাছেই। ইয়া মোটা দেওয়াল, গরিবের চীনের প্রাচীরও বলতে পারেন একে। যতদূর জানা যায় পুরাতন গৌড় এইরকম পাঁচিল দিয়েই ঘেরা ছিল। ২২ গজ প্রাচীর, ভাবা যায়?

এর সামনেই মালদার ইতিহাসে নবতম সংযোজন বল্লালবাটি। ২০০৩ সালে মাটির তলা থেকে জনসমক্ষে আসে বল্লাল সেনের এই প্রাসাদ। তবে আমি এই জায়গার সাথে বৌদ্ধ বিহারের অনেক মিল খুঁজে পেয়েছি। এখনো গবেষণা চলছে, আশাকরি খুব তাড়াতাড়ি এই অঞ্চলের আরো বিশদ ইতিহাস আমরা পাবো।

কদম রসুল মসজিদ, ফতে খানের সমাধি, লুকোচুরি দরজা, চিকা মসজিদ ও গুমতি মসজিদ বাইশ গজী পাচিলের কাছেই। কদম রাসুল মসজিদে আছে হজরত মহাম্মদের পায়ের ছাপ, আর তার পাশেই চালা স্টাইলে ফতে খানের সমাধি। গুমতি মসজিদ আর চিকা মসজিদ প্রায় একই রকম দেখতে।

লুকোচুরি দরজা

লুকোচুরি দরজাটা দারুন সুন্দর। নাম যতই লুকোচুরি হোক, ভুলভুলাইয়ার মতো কিছু দেখিনি আমি এখানে। হয়তো এর অন্য কোনো গল্প আছে যেটা আমার জানা নেই।

এছাড়াও যত বাংলাদেশ বর্ডারের দিকে যাবেন একে একে পড়বে লোট্যান মসজিদ, তাঁতীপাড়া মসজিদ, চমকতি মসজিদ। সবকটি মসজিদ অপরূপ কারুকার্য মন্ডিত।

একদম ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থিত কোতোয়ালি দরওয়াজা, লরির বিরাট লাইন থাকায় অতদূর আর যাইনি। বর্ডারের ওপারে আছে ছোট সোনা মসজিদ। যদি ১৯৪৭ এর আগে জন্মাতাম, তবে এমনিই দেখে আসতে পারতাম।

তবে আরেকটা কথা না বললেই নয়। ছেলেবেলায় ইতিহাস বইতে গৌড়কে চিনেছিলাম শশাঙ্কের কথা শুনে, কিন্তু হয়তো আমার দুর্ভাগ্য তার আমলের কোনো নিদর্শন আমার চোখে পড়েনি।

যাই হোক, গৌড় ঘুরে বিকেলবেলায় ফিরে এলাম পশ্চিমবঙ্গ পর্যটনের টুরিস্ট লজে। ফিরে এসে দেখলাম, একজন বিদেশী ভদ্রলোক লনে দাঁড়িয়ে আছেন। ওনার দিকে এগিয়ে ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করলাম, “কোথা থেকে এসেছেন?” উত্তর এলো, “ভেনিস, ইতালি”। রবীন্দ্রনাথের কবিতাটা কি মনে পড়ছে, “দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া…”।