টেরাকোটার টানে

আজ সপ্তমী। ম্যাজিক্যাল বেঙ্গলের সমস্ত শুভানুধ্যায়ীদের শারদ শুভেচ্ছা জানিয়ে শুরু করছি আজকের গল্প। আজকের বিষয় বাংলার মন্দিরশৈলী। চালা, রত্ন, দেউল, চাঁদনী, দালান, মঠ, মঞ্চ ইত্যাদি মন্দিরশৈলীর নাম হয়তো আপনারা আগে শুনেছেন। আজ আমি আপনাদের নিয়ে যাব বাংলার এমন এক জায়গায় যেখানে প্রায় সবরকমের স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন পাবেন। আমি আর ইন্দ্রনীল, বেশ কয়েকবছর আগে কালনা গিয়েছিলাম টেরাকোটার টানে। টেরাকোটা ছাড়াও পেয়েছিলাম আরও অনেককিছু।
ইন্দ্রনীল এখন কর্মসূত্রে বোম্বেতে, তবুও ওর বাংলা অন্বেষণে একটুকুও ভাটা পড়েনি। ভিবজিওর নামে ছোট্ট একটা গ্রুপ আছে ওর। সময়সুযোগ পেলে ওদের সাথে বাংলাকে নতুন করে খুঁজতে বেরিয়ে পড়তেই পারেন। ফটো ওয়াক করতে করতে আমাদের প্রিয় বাংলাকে জানতে আপনার বেশ ভালোই লাগবে।
গল্পটা শুরু করি। এক শুক্রবার ইন্দ্রনীলের ফোন এলো বোম্বে থেকে। জানতে পারলাম ভিবজিওর একটা কালনাতে ফটো ওয়াকের পরিকল্পনা করছে। সেখানে ইন্দ্রনীল থাকতে পারবে না, থাকবে সৌরভ। ভালো কথা ইন্দ্রনীলের মতো সৌরভও দারুন ছবি তোলে। নাহ, প্রসঙ্গে ফিরি।
কলকাতা থেকে দূরত্ব: ৯৪ কিমি
নিকটবর্তী রেলওয়ে স্টেশন: অম্বিকা কালনা রেলওয়ে স্টেশন
যেহেতু ইন্দ্রনীল থাকতে পারবে না, তাই আমার ওপর দায়িত্বে পড়ল সবাইকে কালনা ঘোরানোর। ঠিক আছে, আসুন বেরিয়ে পড়ি। কথামতো সবাই হাওড়াতে মিট করে হাওড়া-কাটোয়া লোকালে চেপে পাড়ি দিলো অম্বিকা কালনা। আমি অবশ্য উঠেছিলাম কোন্নগর থেকে। ঘন্টাখানেক পর পৌঁছলাম গন্তব্যে।
কালনায় নেমে হেভি ভয় পেয়ে গেলাম। আরিব্বাস, সবার হাতে ইয়া বড় বড় কামান, ইয়ে মানে থুড়ি ক্যামেরা। আর আমার? পুচকে একটা সোনি সাইবারশট। কিন্তু তাতে কি? আমিই তো পথ প্রদর্শক। সবার সাথে সংক্ষিপ্ত পরিচিতি সেরে, শুরু করলাম পথ চলা। প্রথম গন্তব্য সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির।
সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির ফটোশিকারীদের শিকারপর্ব
এবার একটু তথ্য দিচ্ছি। সিদ্ধেশ্বরী কালীর বা দেবী অম্বিকার নামেই এই অঞ্চলের নাম হয়েছে অম্বিকা কালনা। ইনি বর্তমানে হিন্দু দেবী হলেও এনার প্রতিষ্ঠা হিন্দু দেবী হিসেবে হয়নি। ইনি ছিলেন জৈন দেবী। মন্দিরের ফলক থেকে জানা যায় ১৭৪০ খ্রিস্টাব্দে এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল বর্ধমানের রাজা চিত্র সেন রায় কতৃক। তবে ঐতিহাসিকদের মতে ১৬৬৩ খ্রিস্টাব্দে এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, আর ১৭৪০ এ সংস্কার হয়েছিল চিত্র সেন রায়ের হাতে।
জোড় বাংলা মন্দিরশৈলীতে তৈরী হলেও, অবৈজ্ঞানিক সংস্কারের কারণে এই মন্দির আভিজাত্য হারিয়েছে। কাছের অনন্ত বাসুদেব মন্দিরেরও একই হাল। যাই হোক, ছোট্ট মন্দির চাতালে সবাই তাদের ফোটোগ্রাফি করে রওনা দিল পরের গন্তব্যে। জানি, সবার এই জায়গাটা খুব একটা ভালো লাগেনি। আসলে পরের জায়গাগুলো যাতে সবার অসাধারন লাগে, তাই এই দুস্টুমি।

তা রত্ন মন্দির সম্বন্ধে হয়তো আপনাদের সবার ধারণা আছে। যেমন আমাদের দক্ষিণেশ্বরের কালী মন্দির নবরত্ন, মানে মন্দিরে নয়টা চূড়া। কালনায় এলে দেখতে পাবেন পাঁচিশটা চূড়ার মন্দির বা পঞ্চবিংশতি রত্ন মন্দির। আমি যতদূর জানি গোটা বাংলায় এমন সুউচ্চ মন্দির দেখতে পাওয়া খুব দুস্কর, খুব বেশি হলে গোটা পাঁচেক। কালনায় পাবেন এমন পঞ্চবিংশতি রত্নের তিনটে মন্দির। তার একটা আমাদের এখনকার গন্তব্য, গোপালবাড়ি মন্দির।
গোপালবাড়ি মন্দিরচিত্র গোপালবাড়ি মন্দিরে সঙ্গম দৃশ্য
টেরাকোটায় সমৃদ্ধ অসাধারন এই মন্দির অনেক কথা বলে যায়। সামনে হলুদ রঙে রাঙানো জগমোহন আর পিছনে বিশালাকায় পঞ্চবিংশতি রত্ন মন্দির। মন্দির গাত্রে অনেক অজানা চিত্রকলা আপনাকে স্তম্ভিত করবেই। এই মন্দিরগাত্রে আপনি পাবেন সঙ্গমচিত্র, যা গোটা বাংলার যেকোনো মন্দিরে খুঁজে পাওয়া খুবই কষ্টসাধ্য। বয়সে বেশ নবীন এই মন্দির। এই কারনে মন্দিরগাত্রে পৌরাণিক হিন্দু গল্পকথা থেকে শুরু করে জৈন, বৌদ্ধ, ইসলাম থেকে ব্রিটিশ আচার আচরণের অলংকরণও আপনি পরিলক্ষিত করতে পারবেন। গোপালবাড়ির পর আমরা এবার যাবো কালনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজবাড়ী কমপ্লেক্সের দিকে।
রাজবাড়ী কমপ্লেক্স কালনার সবচেয়ে পপুলার জায়গা। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষজন এখানে আসেন। রাস্তার একদিকে রাজবাড়ী মন্দির কমপ্লেক্স, অন্যদিকে নবকৈলাশ। আমরা প্রথমে যাবো নবকৈলাশ।
নবকৈলাশ অথবা ১০৮ শিবমন্দির কালনার এক আইকনিক জায়গা। ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে বর্ধমানের রাজা তেজ চন্দ্র বাহাদুর তৈরী করেছিলেন এই ১০৮ খানা আটচালা শিবমন্দির। এই মন্দির দুটি গোলাকৃতি বৃত্তে বিভক্ত। ইনার সার্কেলে ৩৪ টা আর আউটার সার্কেলে ৭৪ টা মন্দির নিয়ে গঠিত এই নবকৈলাশ। ইনার সার্কলের সবকটা শিবলিঙ্গ সাদা আর আউটারে একটা সাদা আর একটা কালো।
এখানে প্রত্যেকটি শিবমন্দির এক বিশেষ জ্যামিতিক ছকে বাধা, যেটা জপমালার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। একে আপনি শিবক্ষেত্র বললেও ভুল বলা হবে না। প্রচুর পরীক্ষার পর এক নির্দিষ্ট অঙ্কে নবকৈলাশ তৈরী, তার প্রমান অনেক। যেমন প্রতিটি শিবলিঙ্গের বিষ্ণু ভাগের পিঠ (লিঙ্গের মাঝখানের লম্বা ঝুলন্ত জায়গাটা) উত্তরমুখী, পর পর শিবমন্দির গুলোতে ঢুকলেই বুঝতে পারবেন। কমপ্লেক্সের পরিধির সাথে সামঞ্জস্য রেখে একটু একটু করে শিবলিঙ্গগুলো ঘুরেছে। তারপর প্রত্যেক মন্দিরের দরজার ওপরে আলাদা আলাদা ফুলের ভাস্কর্য। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ সুন্দর ভাবে শিবমন্দিরগুলোর সংস্কার করেছেন যা দেখলে পুরনো দিনের গন্ধ পাবেন অনায়াসে। এরপর চলুন রাজবাড়ী কমপ্লেক্সে।

রাজবাড়ী কমপ্লেক্সে বড় ছোট অনেক মন্দির থাকলেও আপনার নজর কেড়ে নেবে ঢুকেই বাম হাতের প্রতাপেশ্বর মন্দির। বয়সে সবচেয়ে নবীন এই মন্দির, তাই এই মন্দিরের টেরাকোটার নকশাগুলো যথেষ্ট তাজা।
প্রতাপেশ্বর মন্দির
দেউল স্টাইলে তৈরী এই মন্দিরের আকর্ষণীয় রূপ যেকোনো ফোটোগ্রাফারের কাছে লোভনীয়। দেবী দূর্গা থেকে সমসাময়িক সমাজব্যবস্থার ছবি আপনি এই মন্দিরের গায়ে দেখতে পারবেন। আর প্রতাপেশ্বর মন্দিরের পিছনের দিকের টেরাকোটার কাজগুলো দেখতে ভুলবেন না যেন। ওগুলো অনবদ্য।

প্রতাপেশ্বর মন্দির থেকে কয়েক পা এগোলেই রাসমঞ্চ। বিষ্ণুপুরের মতো সুবৃহৎ না হলেও এর এক অনন্য সৌন্দর্য আছে।

রাসমঞ্চ থেকে দশ কদম দূরে প্রাচীর বেষ্টিত সুউচ্চ লালজী মন্দির। এটাও গোপালবাড়ির বাড়ির মতন পঞ্চবিংশতি রত্ন। আর এর উল্টোদিকে একেবারে অন্যরকম দেখতে গিরিগোবর্ধন মন্দির। কালনার পঞ্চবিংশতি রত্নের সবকটা মন্দিরগাত্র অসংখ্য টেরাকোটার কাজে সমৃদ্ধ। লালজী মন্দিরও তার ব্যতিক্রম নয়। সামনে জগমোহন আর পিছনে টেরাকোটা সমৃদ্ধ মন্দির, বেশ দারুন লাগে।

লালজী মন্দির থেকে বেরিয়ে বাম হাতে পড়বে আরো একটা পঞ্চবিংশতি রত্নের মন্দির। যার নাম কৃষ্ণচন্দ্রজী মন্দির। হাটা মারুন ওদিকে, ওইটুকু যেতেই পথে পড়বে, একটা ঠাকুর দালান আর কয়েকটা ছোট বড় আটচালা মন্দির।
কৃষ্ণচন্দ্রজী মন্দিরও পঞ্চবিংশতি রত্ন এবং আমার মতে কালনার সবচেয়ে সুন্দর মন্দির। আর বেশি বললাম না। নিজে ঘুরে দেখে আসুন কালনা আর ফিরে এসে পরিচিতদের জিজ্ঞাসা করুন, “কত উঁচু মন্দির দেখেছো তুমি?”

ভিবজিওরের আমরা সবাই বেশ আনন্দ করেছিলাম। খুব সুন্দরভাবে সাজানো এই কমপ্লেক্স। এককথায় ফটোশিকারীদের স্বর্গরাজ্য। ছবি তোলার সাথে খোশ গল্প আর ইতিহাসের আলাপচারিতা বেশ উপাদেয় করেছিল আমাদের একদিনের এই ফটো ওয়াককে।

ভিবজিওরের সাথে জুড়তে যোগাযোগ করতে পারেন: www.infovibgyor.com অথবা খুঁজে নিন ওদের অফিসিয়াল ফেসবুক বা ইন্সটাগ্রামে।
কালনা যদি আরো ঘুরতে ইচ্ছে করে, তবে দেখতে পারেন আরো অনেক কিছু, যেমন বিজয় বৈদ্যনাথ মন্দির, ভবা পাগলার মন্দির, মহাপ্রভু বাড়ি, জাগ্গানাথ বাড়ি, শ্যামসুন্দর মন্দির, দাঁতনকাঠিতলা মসজিদ, রাইস মিল ইত্যাদি।
তবে আর দেরি না করে, কোনো এক উইকেন্ডে ঘুরে আসুন কালনা।
বিজয় বৈদ্যনাথ মন্দির ভবা পাগলার মন্দির
আর হ্যা, পুজোতে বাড়িতে বসেই পরিবারের সাথে খুব আনন্দ করুন। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।
ধনঞ্জয় নাথ
সুজয়বাবু ,আপনাকে প্রথমেই জানাই শুভ মহাষ্টমীর শুভেচছা, আপনার ভিবজিওরের সাথে জুড়তে আমি ইচ্ছুক। আমার ইমেইল ঠিকানা নীচে দিলাম। আপনার সন্মতির অপেক্ষায় রইলাম। ধন্যবাদ।
সুজয় ঘটক
ইন্দ্রনীল আপনার সাথে যোগাযোগ করে নেবে।