নামকরণ সার্থক…

কলকাতার লোকজনকে যদি সপ্তাহান্তে কাছে পিঠে বেড়াতে যেতে বলা হয়, তবে একটাই নাম আসবে তাদের মনে। সেটা দিঘা। আমি যে কতবার গেছি এখানে তা হিসেব করা মুশকিল, কিন্তু শেষবার দিঘা যাওয়ার পরে বুঝেছি, কেন অতীতের ছোট্ট গ্রাম বীরকুলের নাম আজ দিঘা হয়েছে।
পড়ন্ত বিকেলে অফিসে বসে একদিন ঠিক করে ফেললাম দিঘা যাবো। সেই মতো অনলাইনে হাওড়া – দিঘা সুপার এসি এক্সপ্রেসের এক্সেকিউটিভ ক্লাসের টিকেট কেটে নিলাম। বাড়ি ফিরে গিন্নিকে বললাম, এই উইকেন্ডে দিঘা যাবো। সবার খুব আনন্দ। প্রসঙ্গত বলে রাখি, এই গল্পটা সেই সময়কার, যখন দেশে ট্রেন চলতো।
কলকাতা থেকে দূরত্ব: ১৮৬ কিমি
নিকটবর্তী রেলওয়ে স্টেশন: দিঘা ফ্ল্যাগ রেলওয়ে স্টেশন
শনিবার সকালে একটা উবের বুক করে বেরিয়ে পড়লাম হাওড়ার উদ্দেশ্যে। ১১টার সময় ট্রেন, একটু তাড়াতাড়িই বেরিয়েছিলাম। হাওড়ায় পৌঁছে উঠে পড়লাম ট্রেনে, ই ১ কামরার মাঝামাঝি তিনটে সিট। জানলার পাশে বড় ছেলে, মাঝে গিন্নি, আর সাইডে ছোট ছেলেকে কোলে নিয়ে আমি। হটাৎ পিছন থেকে আমার কাঁধে হাত দিয়ে একজন বলে উঠলো, “দাদা, এই সিটগুলো মনেহয় আমাদের।”
ঘুরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনাদের সিট নম্বর কত?” ওনারা ওনাদের হাতের টিকিট এগিয়ে দিলেন, দেখলাম একই সিট নম্বর, একই কামরা। এরকম হয় নাকি? কিছু বুঝতে পারছিলাম না, হটাৎ চোখ গেলো ডেটের দিকে, দেখেই চক্ষু চারকগাছ। একি টিকিট তো শুক্রবারের, আর আমি এসেছি শনিবারে। সবাই দেখি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আস্তে করে উঠে দাঁড়ালাম, গিন্নিকে বললাম, “ওঠো”। গিন্নি তো থতমত খেয়ে গেছে, কি যে হয়েছে সেটা আসলে তখন ও বুঝতে পারছে না। গিন্নি আর ছেলে উঠতেই , আমি ওনাদের বললাম, “বসুন, এটা আপনাদেরই সিট”। উনি জানতে চাইলেন, আমাদের সিট কোথায়? সত্যিটা আর বলতে পারলাম না, বললাম, “আমাদের সিট পাশের কামরায়, দেখতে ভুল হয়েছিল।”
কয়েক কদম এগিয়ে দেখি চেকারসাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। এগিয়ে গেলাম তার কাছে। বললাম, “স্যার, একটা মস্ত ভুল করে ফেলেছি। শুক্রবারের টিকিট কেটেছিলাম, আর ভুল করে আমরা এসেছি শনিবার। ট্রেনে কি আমাদের যাওয়ার কোনো বন্দোবস্ত হতে পারে? প্রয়োজন হলে, আমি ফাইন দেওয়ার জন্যে রেডি আছে।” কাচুমাচু মুখে, উনি বললেন, “দেখুন, উইকেন্ডে একটা সিটও ফাঁকা নেই, আর কারেন্ট রিসার্ভেশন দেখতে পারেন কাউন্টারে গিয়ে।” তারপর, হাতের ঘড়িটা দেখে বললেন, “লাভ নেই, গাড়ি ছাড়তে আর তিন মিনিট বাকি। ওখানে পেলেও বাচ্চাদের নিয়ে গাড়ি ধরা আপনার পক্ষে কঠিন। এরপরে কান্ডারী আছে, ওতে দেখুন, পেলেও পেয়ে যেতে পারেন।” নাহ, আর আশা নেই, সপরিবারে নেমে এলাম ট্রেন থেকে।
বাড়ি থেকে যখন বেরিয়ে পড়েছি, ফিরে আসার আর প্রশ্ন নেই। ওদের স্টেশনে বসিয়ে দৌড় লাগলাম, বাসস্ট্যান্ডের দিকে, দিঘা পৌঁছতেই হবে।
খেলাম সিঁড়িতে হোঁচট, গেলো ছিড়ে চটিটা। এক মুচিভাইকে দেখলাম। সে মোটামুটি সেলাই করে কাজ চালানোর মতো ঠিক করে দিলো। বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে শুনি ৫ মিনিট আগে দিঘার বাস বেরিয়েছে। পরের বাস ২ ঘন্টা পর। জিজ্ঞাসা করলাম, ২ ঘন্টা কেন? স্ট্যান্ড থেকে বললো, আগের বাসটা ব্রেকডাউন করেছে, তাই আজ বাতিল। কি আর করবো, ফিরে এলাম স্টেশনে।
একটা ওলা অউটস্টেশন নিলে কেমন হয়? দিলাম ডেস্টিনেশন দিঘা। ওরে বাবা, ৫০০০ টাকা চাইছে যে, আসবে আবার সেই ২ ঘন্টা বাদে। ধুর, ধুর ক্যানসেল। এবার মিশন কান্ডারী।
টিকিট তো নেই, কারেন্ট রিসার্ভেশনও নেই। কিন্তু যেতে তো হবেই। খিদেও পেয়ে গেছে। ট্রেনে এলাহী খাবো বলে বাড়ি থেকেও একটু কম খেয়েই বেরিয়েছিলাম। গেলাম জন আহারে, দাঁড়ানোর জায়গা নেই। কিছু স্নাক্স নিয়ে মোটামুটি লাঞ্চ সারলাম, তারপর, প্লাটফর্মে বইসা আছি, কখন বাজে দুইটা, কখন বাজে দুইটা।
১৮০০১ কান্ডারী এক্সপ্রেস ২০ নম্বর প্লাটফর্মে আসছে। দৌড় লাগলাম, প্লাটফর্মের শেষ প্রান্তে। ট্রেনের জেনারেল কামরা স্টেশনে ঢুকতেই দে লাফ। সোজা ট্রেনের মধ্যে। আপনারা কেউ এই স্ট্যান্ট করবেন না, বিপদ হতে পারে। যদি শিয়ালদহ থেকে অফিস টাইমে লোকালে উঠে উইন্ডো সিট নেওয়া আপনার কাছে জল ভাত হয়, তবে পারতে পারেন। কিন্তু প্রয়োজন না পড়লে, এই স্ট্যান্ট করবেন না। যাই হোক, ট্রেনে উঠে সটান শুয়ে পড়লাম, একটা সিটে। জবরদখল ছাড়া উপায় নেই। ফার্স্ট কাম, ফার্স্ট সার্ভ।
আহা, ভেবেছিলাম এসি ট্রেনে চেপে ভালোমন্দ খেতে খেতে পৌঁছবো দিঘা। এখন কান্ডারীর জেনেরালে চেপে, বাদামভাজা চিবোতে চিবোতে ঘেমে স্নান করে, পৌঁছচ্ছি দিঘা। ও আচ্ছা, আমাদের মাথার ওপরের ফ্যানটা চলছিল না। পেন দিয়ে অনেক চেষ্টা করলাম, ফ্যানটা সত্যিই খারাপ হয়েছে।
ঢিকির ঢিকির করতে করতে ৭টা নাগাদ ট্রেন ঢুকলো দিঘায়। একটা যুদ্ধজয়ের হাসি বেরিয়ে এলো ঠোঁটের ফাঁক গলে। কিন্তু, যুদ্ধ তো এখনো শেষ হয়নি।
দিঘা স্টেশন থেকে বেরোতেই চরম বৃষ্টি। কোনো রকমে একটা অটো ভাড়া করে পৌঁছলাম দীঘার হোটেলে। আগে থেকেই ইন্টারনেটে বুক করে রেখেছিলাম। হোটেল আসতে আসতে বৃষ্টিটা একটু ধরলো। যাক, পৌঁছে গেছি হোটেল, আর নো চিন্তা। আবার যুদ্ধজয়ের হাসি, কিন্তু…
হোটেলের রিসেপশনে পেনটা হাতে নিতেই চারদিক অন্ধকার। যা কারেন্ট গেলো, জেনেরেটর নিশ্চই আছে, এতো বড় হোটেল। কিন্তু কারেন্ট আসছে না কেন? শুনলাম, হোটেলের এক কর্মচারী তেল আনতে গেছে। জেনেরেটরে তেল নেই। বাহ্, বাহ্ … কি অসীম লীলা তোমার। অবশেষে সেই কর্মচারী এলো, জেনেরেটর চললো, কারেন্ট এলো। অটোগ্রাফ দিয়ে, চললাম আমাদের প্রিমিয়াম সুইটের দিকে। লিফ্ট বন্ধ, কারণ তার গা দিয়ে জল গড়াচ্ছে। অগত্যা, পদব্রজে উঠলাম তিনতলায়।
ঘরটা বেশ বড়। ওয়ারড্রোবটা খুলে জামা কাপড় রাখতে গিয়ে দেখি, দুইখানা সুদৃশ ফাঁকা বোতল রাখা। মেজাজটা আর ধরে রাখতে পারলাম না, দিলাম ফোন রিসেপশনে। উত্তম মধ্যম দিলাম, হোটেলের এক কর্মচারী ভুলভাল যুক্তি দিতে দিতে ওগুলো নিয়ে গেলো। কোনো সিস্টেম নেই।
যাই হোক, খিদে খিদে পাচ্ছে, ফোন লাগলাম রিসেপশনে। স্নাক্স কি আছে? কাচুমাচু গলায় ম্যানেজার বললেন, দাদা, আজ এতো বৃষ্টিতে কুক বাড়ি চলে গেছে। বাড়ি চলে গেছে মানে, এই বৃষ্টিতে যাবো কোথায়। বললাম, আমি আসছি নিচে।
নিচে আসতেই ম্যানেজারবাবু বললেন, দাদা, আপনার কি লাগবে বলুন, আমি লোক পাঠিয়ে আনিয়ে দিচ্ছি। আমি বললাম, কিচ্ছু লাগবে না, আপনি একটা ছাতার ব্যবস্থা করুন, যা আনার আমি এনে নিচ্ছি। গজগজ করতে করতে ছাতা নিয়ে বেরোলাম, খাওয়ারের খোঁজে। সমস্যা যখন যেচে তৈরী হচ্ছে, তখন তার সমাধান নিজেকেই করতে হবে। হাফ রাস্তা গিয়ে, খেলাম পিছল। পড়িনি, কিন্তু জুতোটা আবার গেছে ছিড়ে। কি আর করবো, ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে কোনো রকমে তিনটে বিরিয়ানি নিয়ে ঢুকলাম হোটেলে।
“দাদা, আপনি তো ভিজে গেছেন।” হোটেলে ঢুকতেই করুন কন্ঠে বললেন ম্যানেজারবাবু। ছাতাটা ওনাকে দিয়ে বললাম, “তিনটে প্লেট রুমে দিয়ে আসতে পারবেন, নাকি সেটাও আনিয়ে নিতে হবে?”
“না স্যার, আপনি যান, আমি পৌঁছে দিচ্ছি।”
ম্যানেজারবাবু অভয় দিলেন
হয়তো একটু রুড ছিলাম সেদিন, কি আর করবো, মানুষ তো। আবেগ মাঝে মাঝেই বেরিয়ে আসে। প্লেট ঘরে পৌঁছতেই, গিন্নিকে বললাম, “দিয়ে দাও বিরিয়ানি, জোর খিদে পেয়েছে।” গিন্নি প্লেট বিরিয়ানি ঢালতে ঢালতে বলল, ভেজ বিরিয়ানি এনেছো নাকি। উত্তর দিলাম, নাহ মটন বিরিয়ানি এনেছি, তবে আজ এতে মটন নাও থাকতে পারে। নাহ, মটন ছিল। একটা ছোট্ট টুকরো পড়েছিল প্যাকেটের কোনায়।
বিরিয়ানিটা বেশ ভালোই ছিল খেতে, আমার প্যাকেটটাতে মটনের টুকরোটা ছোট থাকলেও, অন্য দুটোতে বেশ বড় বড় ছিল। তবে, খাওয়া দাওয়া করে আর যুদ্ধজয়ের হাসি হাসিনি। কি যে অপেক্ষা করছে, কে জানে। তারপর, আর কি, খেয়ে দিয়ে ঘুম দিলাম। আজকে আর সমুদ্র দেখা হলো না, ঠিক আছে কাল দেখবো। ফেরার বাস তো ১২টায়।
সকালে একটু দেরি করেই ঘুম ভাঙলো, ৮:৩০ নাগাদ উঠে, হোটেলের কম্প্লিমেন্টারী ব্রেকফাস্ট সেরে রওনা দিলাম বঙ্গোপসাগর দেখতে ১০টা নাগাদ। হোটেল থেকে খুব বেশি হবে ২-৩ মিনিট লাগবে।
ছোটছেলে তখন বেশ ছোট, একবছর হয়নি। হোটেলের গেটে আসতেই হটাৎ পট পট করে আওয়াজ, ওমা, আমার হাতটা ভেজা ভেজা লাগছে কেন। ঘুরে গিন্নিকে বললাম, ডায়পার পরাওনি? তারপর, সমুদ্রের দিকে না গিয়ে আবার রওনা দিলাম আমাদের রুমের দিকে। তারপর বাকি সময়টা রুমেই কেটে গেলো। রুম ছেড়ে, পেট্রল পাম্পের অপজিটে একটা রেস্তোরাঁয় লাঞ্চ সেরে টোটো ধরে চললাম, বাস ধরতে।

বাসস্ট্যান্ডে এসে, সপরিবারে গেলাম সমুদ্র দেখতে, হাতে তখন সময় আর ১৫ মিনিট। ওইটুকু টাইমে যতটা সমুদ্র দেখা যায়, ততটুকুই দেখলাম। একটু আগে আগেই ফিরে এলাম বাসস্ট্যান্ডে। ফাঁকা পুরো, বড়ো ছেলে জিজ্ঞেস করলো, “বাবা, বাসটাও কি চলে গেছে?” নাহ, যায়নি, ওই তো আসছে।

সত্যি দি – ঘা … তোমার নামকরন সার্থক। হাড়ে হাড়ে আজ বুঝেছি, তোমার নামের মর্মার্থ। শেষমেশ বাড়ি ফিরে, বীরের মতো যুদ্ধজয়ের হাসিটা দিয়েছিলাম। সসম্মানে বাড়ি ফিরেছি বলে কথা, পুরুর মতন হাসি তো দিতেই হবে। যতই হোক, ব্রিটিশ জামানার বীরকুল গ্রামটাই তো আজ আমাদের প্রিয় দিঘা। সেলাম তোমায় দি-ঘা। এরপর গেলে আর ঘা দিও না।
কেমন লাগলো আমাদের এই যুদ্ধ জয়, সেটা নিচে কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না। আপনাদের অনুপ্রেরণা আমাদের আরো লিখতে উৎসাহিত করবে।
Bholanath Roychowdhury
Darun ! Darun !
Mandarmoni neay kichhu likhoon dada…