বুদ্ধ ঘুমোচ্ছেন যেখানে

গল্পটা অনেকদিন আগের। ২০০৬ এর ডিসেম্বর। সদ্য চাকরী পেয়েছি তখন, ডিসেম্বরের শীতে আমাদের অফিস থেকে লম্বা ছুটির পরিকল্পনা করা হলো, গন্তব্য দার্জিলিং জেলার তুমলিং। সেইমতো ২২শে ডিসেম্বর শিয়ালদহ থেকে উঠে পড়লাম উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেসে। ট্রেনের কামরায় অবিকল করিনা কাপুরের মতো দেখতে একজন প্যাসেঞ্জার ছিল, যদিও তার বাবাকে একদমই রণধীর কাপুরের মতো দেখতে ছিল না। নাহ, প্রসঙ্গে ফিরি।
কলকাতা থেকে দূরত্ব: ৬১৩ কিমি
নিকটবর্তী রেলওয়ে স্টেশন: নিউ জলপাইগুড়ি অথবা শিলিগুড়ি
সারারাত তাস পেটাতে পেটাতে আমরা পৌঁছলাম নিউ জলপাইগুড়ি জংশন। দলে ছিল মিঠুন দা, গোবিন্দ দা, রামু দা, অভিজিৎ, সৌগত, সুদীপ, খোকন, প্রভাত, রাজীব দা আর আমি। স্টেশনে নেমে টিফিন করে একটা গাড়ি ভাড়া করে চলতে রওনা দিলাম মানেভঞ্জনের উদ্দেশ্যে। শিলিগুড়ি, সেবক হয়ে মিরিকের চা বাগানের বুক চিড়ে চলতে লাগলো আমাদের গাড়ি। সে এক দারুন অনুভূতি।

মিরিকে একটু ফটোসেশন করে আমরা আবার চলতে লাগলাম গন্তব্যের পথে। প্রায় ছয় ঘন্টা লেগেছিলো মানেভঞ্জন (৭,০৫৪ ফিট) পৌঁছতে। যদিও এতক্ষন লাগে না। রাস্তার দুধারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দেখে বারে বারে নেমেছি আমরা গাড়ি থেকে। দুচোখ ভোরে দেখেছি দার্জিলিং জেলার মোহময়ী রূপ। অনেকে মানেভঞ্জন পৌঁছতে কার্শিয়াংয়ের রুট ধরেন। সত্যি বলতে ওই রাস্তার চেয়ে মিরিক হয়ে মানেভঞ্জনের রাস্তা অনেক অনেক বেশি সুন্দর। এর পরে অনেকবারই দার্জিলিং গেছি, কিন্তু প্রত্যেকবারের জন্যে বেছে নিয়েছি মিরিকের রুটকে। এই রাস্তায় উচ্চতার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে প্রকৃতির রূপ। প্রকৃতি এবং অতি-প্রকৃতির মধ্যে পার্থক্য এখানে খুবই কম। আর সেই রূপ আপনাকে অবাক করবেই।
উরি বাবা, কি ঠাণ্ডারে ভাই!
মানেভঞ্জন পৌঁছে এই কথাটাই মুখ থেকে বেরিয়েছিল।
যাই হোক, মানেভঞ্জন পৌঁছে উঠলাম হোটেল প্রধানে। সাধারণ মানের লজ, এখানে এর থেকে বেশি আশা করা দুস্কর। প্রচন্ড ঠান্ডা, কাটানোর উপায় কি? একটাই, একটু কষ্ট করে ঠান্ডা জলে স্নান করে নিতে হবে, যেই না ভাবা সেই কাজ। কনকনে ঠান্ডা জলে গায়ে ঢেলে নিলাম কয়েক মগ জল। তারপর ইনস্ট্যান্ট এফেক্ট, সোজা লেপের তলা।

বিকেলে সবাই মিলে বেরোলাম, মানেভঞ্জনের আনাচে কানাচে ঘুরতে। ওখানে পাহাড়ের ওপর একটা মন্দির আছে, অনেকগুলো সিঁড়ি পেরোতে হয়। কোনোরকমে উঠলাম সেখানে। কি প্রচন্ড হাওয়া, জ্যাকেটের মধ্যে দিয়ে হাড়গোড় কেঁপে গিয়েছিলো। নেমে এলাম নিচে। সৌগত বললো, চলো তোমাদের নেপাল ঘুরিয়ে নিয়ে আসি।
যা বাবা, নেপাল আবার কথা থেকে এলো। মুখের কথা শেষ হতে না হতেই সৌগত হাত উঁচিয়ে বললো, আমাদের হোটেল থেকে তিন চারটে বাড়ির পরে যে কালভার্ট দেখছো, ওটা পেরোলেই নেপাল। আমাদের ঠিক বিশ্বাস হলো না, কাঁটাতারের বেড়া নেই, কোনো আর্মি নেই, কি করে ওটা নেপাল হতে পারে!!! ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে বললাম, বাজে কথা বোলো না। তারপর সৌগত মোটামুটি আমার হাত ধরে প্রায় টানতে টানতে নিয়ে গেলো আমায় কালভার্টের ওপারে, তারপর হাতের ইশারায় ডানদিকে দেখতে বললো। দেখি, বোর্ডে জ্বলজ্বল করছে, “ওয়েলকাম তো নেপাল”। তারপর বিকেলটা আমরা নেপালেই ফটোসেশন করে কাটিয়ে দিলাম।
সন্ধ্যে নামার সাথে সাথে ঠান্ডা বাড়তে লাগলো। এখন লাল চা-ই ভরসা। তার দেরি না করে গ্যালন গ্যালন চা পান করে, শুয়ে পড়লাম। সকালে উঠতে হবে যে। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, এই চা সেই চা নয়, অন্যরকম চা।
রাতে ঘুমটা ভালো হয়নি। পেট গরম হয়ে গিয়েছিলো। ঠান্ডার চোটে মোজা, মাঙ্কি ক্যাপ না খুলেই ঢুকেছিলাম লেপের তলায়, সাথে অতিরিক্ত চা পান, সব মোটামুটি একসাথে এফেক্ট করেছিল। ভোরের দিকে যা একটু ঘুম ঘুম আসছিলো, তখন দেখি সব ডাকছে, ওরে ওঠ ওঠ। কি বিরক্তিকর!!!
লেপের তলা দিয়ে মুখটা বাড়িয়ে বললাম, “আমি যেতে পারবো না, শরীরটা ভালো নেই”। যেই না বলা সঙ্গে সঙ্গে মিঠুন দা বললো, “তুমি যদি না যাও, তবে আমরা কেউ যাবো না… এখন থেকেই ফেরৎ যাবো”। বস সেন্টিমেন্টের খোঁচা দিলে, উঠে বসতেই হয়।
এই জীবনের পথ সোজা নয় জেনো, বড় আঁকাবাঁকা বন্ধুর। হাঁটার শুরুর আগে ভেবেছিলাম, কতক্ষন আর লাগবে! লেগেছিলো প্রায় ১৩ ঘন্টা।যদিও মানেভঞ্জন থেকে তুমলিংয়ের দূরত্ব ১১ কিলোমিটার। আসলে আগে কোনোদিন ট্রেক করিনি তো, তাই বুঝতে পারিনি। ২০১৩ তে স্ত্রী পুত্রকে নিয়ে আবার গিয়েছিলাম সেখানে, তখন সময় লেগেছিলো মাত্র দেড় ঘন্টা। ল্যান্ড রোভারে গিয়েছিলাম তো। পরের বারের ট্যুরের গল্পটা অন্য একদিন বলা যাবে।

ভোর ৫ টার সময় শুরু হল পথচলা, সাথে আমাদের গাইড ন্যাসপাতিজি। বয়স ৭০ পেরিয়েছে তার, কিন্তু একদম ফিট। এই রাস্তায় চলে গেছে সোজা সান্দাকফু হয়ে ফালুট। আমাদের হাতে সময় কম ছিল, তাই আমরা ঠিক করেছিলাম তুমলিং যাবো, একদিন উঠবো, পরের দিন নেমে আসবো।
মানেভঞ্জন থেকে বেশ ফুরফুরে মেজাজেই উঠছিলাম। হটাৎ দেখি অভিজিৎ ক্ষেপে গেলো, “এটা কি ট্রেকিংয়ের রাস্তা? পাশ দিয়ে গাড়ি চলে যাচ্ছে। ট্রেকিং কেন পিচের রাস্তা দিয়ে করবো?” সৌগত প্রায় হুঙ্কার ছেড়ে বললো, “চলো তবে পাহাড় চড়ে”। সৌগতর মানেভঞ্জন থেকে সান্দাকফুর রাস্তা হাতের তালুর মতন চেনা, অনেকবার এসেছে আগেই এখানে। তা যাই হোক, রাজীবদার ১২০ কেজি ওজনের চেহারাটা দেখিয়ে অভিজিৎকে শান্ত করা হলো। এখানে বলে রাখা ভালো, আপনি ইচ্ছে করে মানেভঞ্জন থেকে ভিন্টেজ ল্যান্ড রোভার করেও যেতে পারেন তুমলিং হয়ে সান্দাকফু। আমরা যখন গিয়েছিলাম, তখন চিত্রে অবধি পিচ রাস্তা ছিল, এখন শুনেছি গৌরিবাস পর্যন্ত নাকি পিচ রাস্তা হয়ে গেছে।
চিত্রে অবধি রাস্তাটা দারুন সুন্দর, এঁকেবেঁকে আস্তে আস্তে হাটতে হাটতে পৌঁছলাম চিত্রে (৮,৩০০ ফিট)। একটা মাইলস্টোন চোখে পড়লো। এমা, এতক্ষনে মাত্র দুই কিলোমিটার এলাম। মাইলস্টোন ভুল আছে নিশ্চয়ই। প্রচন্ড হাফিয়ে পড়েছিলাম, তাই ২ কিলোমিটারকে ২০ কিলোমিটারের মতো মনে হচ্ছিলো। চিত্রে ছবির মতো সাজানো একটা জায়গা। পাহাড়ের ওপর সবুজ গালিচায় মোড়া একটা মেডো টাইপ। ওখানে একটা ছোট দোকান আছে, ওখানে চমরী গাইয়ের দুধের চা মিস করবেন না যেন।

চিত্রেতে উঠে সবুজ ঘাসের ওপর বসার পর, সব কটা পথে পেঁচিয়ে পড়েছিল।। গা-হাত-পা টনটন করছে। না গেলে কি হয় না। যাহ, রামু দা আর সুদীপ হাটা লাগিয়েছে যে। উঠে পড়ি, আর কি করা যাবে।
একি! পিচ রাস্তা কই! এতো পাথরের রাস্তা। কিন্তু পৌঁছতে তো হবে। হয় উপরে নয় নিচে, মানে পাহাড়ের ওপরে। একটা জিনিস শিখলাম, পাথুরে রাস্তার ওপর দিয়ে হাঁটলে, পায়ে খুব প্রেসার পরে, ওর চেয়ে অনেকগুণে ভালো রাস্তার পাশে মাটির ওপর দিয়ে হাটা। সর্বদা আমার এই উপদেশ মাথায় রাখবেন, তবে প্রথম ট্রেকে তাহলে আপনার অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। আর এই ট্রেক যথেষ্ট সোজা, আপনি পাহাড় থেকে পড়ে যেতে চাইলেও পড়বেন না। বেশ বড়ো রাস্তা।
হটাৎ করেই ক্লান্তি পরিবর্তিত হতে লাগলো থ্রিলে। রাস্তা ছেড়ে আমরা অতিউৎসাহিত হয়ে ধরলাম শর্ট কাট। ঝোপ-ঝাড়, জঙ্গলের মাঝখান থেকে এবড়ো খেবড়ো উঁচু নিচু পথ ধরে হাটতে লাগলাম। আর এক ছিল আমাদের গাইড ন্যাসপাতীজি। যখনি জিজ্ঞেস করা হয়, “তুমলিং কতদূর?” উত্তর আসে, “উস পাহাড়কে পিছে”।

আরে ভাই, কত পাহাড়ের পিছে, একটার পর একটা তো টপকেই যাচ্ছি। উস পাহাড়ের পিছে আর আসছে না। অভিজিৎ একবার তো ওনাকেই জিজ্ঞেস করে ফেললো, “তুমলিং উস পাহাড় কে পিছে, তাই তো?” উত্তর এলো, “হান জী”। হটাৎ দেখি সুদীপ একটা সিঁড়ির ওপরে ইয়া লম্বা জিভ বার করে বসে আছে। ওহ, বলা হয়নি, সুদীপ আর রামু দা, চিত্রেতে একটু চার্জড আপ হয়ে আগেই রওনা হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু বেচারা সুদীপ একটু শর্টকাট মারবে বলে একটা সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে খেয়েছে কেস। পাহাড়ে যাই করুন, সিঁড়ি হইতে সাবধান। উঠলেই দারাম করে হাফিয়ে যাবেন। জীবনকে ওষ্ঠাগত না করতে রাস্তা ধরে হাটাই সুখকর। এইভাবেই চলে এলাম পরবর্তী রেস্ট পয়েন্ট লামাদুরা।
পরের গন্তব্য মেঘমা। লামাদুরা থেকে মেঘমার রাস্তার শোভা বেশ সুন্দর। মানেভঞ্জন থেকে শুরু করার সময় যতটা ক্লান্তি অনুভব করছিলাম, রাস্তায় হাঁটার সাথে সাথে এখন সব ক্লান্তি উধাও। আমার এই পথ চলাতেই আনন্দ। শুধু আমার না, সবার।

এলো মেঘমা, নামের সাথে এই জায়গার খুব মিল। সবাই যেন একসাথে চলে এসেছি মেঘের রাজ্যে। ঘন কুয়াশায় ঢেকে আছে পুরো মেঘমা। হ্যা, এতো উঁচুতেও মানুষ থাকে। আর এখানে পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে উঁচু স্কুলটাও আছে। এলো মেঘমা, নামের সাথে এই জায়গার খুব মিল। সবাই যেন একসাথে চলে এসেছি মেঘের রাজ্যে। ঘন কুয়াশায় ঢেকে আছে পুরো মেঘমা। হ্যা, এতো উঁচুতেও মানুষ থাকে। তাই এখানে পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে উঁচু প্রাইমারি স্কুলটা আছে। এবার আসছে সেমি-ফাইনাল ডেস্টিনেশন টংলু।
মেঘমা আসতে আসতে প্রায় তিনটে বেজে গিয়েছিলো। ন্যাসপাতিজী বললো, মেঘমা থেকে টংলু হয়ে তুমলিং পড়বে চার কিলোমিটার আর একটা খাড়াই রাস্তা আছে মেঘমা থেকে ডাইরেক্ট তুমলিং, মাত্র ২ কিলোমিটার। শোনামাত্র, সেমি-ফাইনাল ক্যানসেল। নাহ, আমরা টংলু যাবো না। সোজা ফাইনাল ডেস্টিনেশন, তুমলিং।
দু-চার পা আগে এগিয়েই থমকে গেলাম। দেখি জলপাই রঙের পোশাকে আগনেয়াস্ত্র নিয়ে আর্মি দাঁড়িয়ে আছে। হেভি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু ভয় পাওয়ার কোনো কারণই ছিল না। আর্মিরা কিছুই বলেনি। আসলে মেঘমা একদম ভারত – নেপাল বর্ডারের একটা গ্রাম। ঠিক মানেভঞ্জনের মতো। তুমলিং যাওয়ার শর্টকাট রাস্তাটা গেছে নেপাল হয়ে, আর ব্রডকাটটা গেছে পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে। মানে ভাবুন, আমাদের জীবনের প্রথম ট্রেকিংটাই ইন্টারন্যাশনাল ট্রেকিং। কি মজা।

মেঘমা হয়ে তুমলিংয়ের রাস্তাটা যতটা খাড়া ভেবেছিলাম, তারচেয়েও বেশি খাড়া। ওই রাস্তা দিয়ে রীতিমতো আমাদের দৌড়োতে হচ্ছিলো। কারণ, সন্ধ্যে হতে আর বেশি দেরি নেই। ওই, ওই তো, বাড়ি-ঘর দেখতে পাচ্ছি। ন্যাসপাতিজী উত্তর দিলো, “আ গ্যায়া তুমলিং”। আচ্ছা, তাহলে তুমলিং লুকিয়েছিল এই পাহাড়ের পিছে।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০,০০০ ফিট উচ্চতায় ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম তুমলিং। গ্রামটা নেপালে হলেও গ্রামের পাশ দিয়ে সান্দাকফু-ফালুট যাওয়ার রাস্তাটা আমাদের বাংলায়। আমরা দুটো ঘর বুক করে ঢুকে পড়লাম সিদ্ধার্থ লজে। শিখর হোটেলের একেবারে পাশে। তুমলিংয়ে গেলে আপনারা বেশ কয়েকটা সাধারণ মানের থাকার জায়গা পেয়ে যাবেন। রাত কাটানোর জন্যে একদম ঠিকঠাক।

ঘরে ঢুকেই আমরা চিৎপাত। পথের সব ক্লান্তি যেন একসাথে সবাইকে গ্রাস করেছিল। হটাৎ শুনি দরজায় ঠক ঠক শব্দ। কারো দরজা খোলার আর শক্তি নেই, কে দরজা খুলবে তা নিয়ে একপ্রস্থ তর্ক-বিতর্কের পর খোকন গেলো দরজা খুলতে। লজের ম্যানেজার বাবু এসেছেন।
শুনলাম, আর একদল ট্রেকিং পার্টি এসেছে তুমলিংয়ে, কিন্তু তারা থাকার জায়গা পাচ্ছে না। ম্যানেজারবাবু আমাদের অনুরোধ করতে এসেছেন, যদি আমরা একটা ঘর তাদের জন্যে ছেড়ে দিই। দেরি না করে একটা ঘর ছেড়ে দিলাম, সবাই ঢুকলাম একটা ঘরে, এইরকম রিমোট একটা জায়গাতে, এছাড়া উপায় নেই। কারণ, যদি টংলু হয়ে আসতাম, আমাদের সাথেও এমন হতে পারতো। চলো, আমরা আটজন এবার একঘরে, সবাই একসাথে হৈ হৈ করবো।
সন্ধ্যার দেশি চিকেনের রোস্টটার স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে। অসাধারণ বানিয়েছিলো, শুধু আমাদের সুদীপ আর রামু দা চাখতে পারেনি, কেন পারেনি সেটা বললাম না। একান্ত গোপনীয়। তারপর আর কি, রাতে গরম গরম ভাত, ডাল, ডিমের ওমলেট দিয়ে ডিনার সেরে সোজা বিছানায়।
আবার দরজায় ঠক ঠক ঠক। এই রে, আবার কোনো ট্রেকিং পার্টি তুমলিং এলো নাকি? প্রায় আটটা বাজে। এমন হলে, আমরা থাকবো কোথায়। দরজা খুলে দেখি, লজের এক কর্মচারী। পকেট থেকে একটা সোনার আংটি বার করে বললো, “ইয়ে ক্যায়া আপ লোগো কে হ্যায়?” আংটিটা নাকি ও হাত ধোয়ার জায়গাতে কুড়িয়ে পেয়েছে। আর আমরাই নাকি লাস্ট ডিনার করে হাতমুখ ধুয়েছি। হটাৎ দেখি, রাজীব দা লাফিয়ে উঠলো, ওর আঙুলের আংটিটা নেই। তারপর আর কি? রাজীবদা আংটিটা পেয়ে গেলো। এখানকার মানুষদের সততা তারিফ করার মতো, অবশ্য সবাই জানে সেটা।
তারপর দিলাম ঠেসে ঘুম। তিনটে সিঙ্গেল খাটে আটজন। মাঝে যে শুয়েছে, তাকে ধরে প্রায় ঝুলে ঘুমোতে হচ্ছে দুপাশের লোকজনকে। হাই আল্টিটিউডে প্রভাতের নাকি মাঝরাতে খুব শরীর খারাপ করেছিল। কি জানি, আমি জানি না। আমি তো অঘোরে ঘুমোচ্ছিলাম।

সকালে ঘুম ভাঙলো, সৌগতর চিৎকারে। দেখে যাও বরফ পড়েছে, এই বলতে বলতে বাচ্চাদের মতো লাফাচ্ছে। ছোট্ট ঘরটা থেকে বাইরে বেরিয়ে দেখি, চারিদিকে ঝিরঝিরে বরফে দেখে গেছে। পুরো সাদা, আমরাও সবাই বাচ্চা হয়ে গেলাম। শুরু হলো লাফালাফি।
এই রে, সূর্য ওঠার টাইম হয়ে গেলো তো। ক্যামেরা কোথায়, কাঞ্চনজঙ্ঘার ওপর সূর্যের প্রথম আলো পড়ার ছবিটা তো তুলতে হবে। এখন থেকে খুব কাছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। পশ্চিমবঙ্গ থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে খুব কাছে থেকে দেখতে হলে আপনাকে আসতেই হবে তুমলিং অথবা টংলুতে। তবে, টংলু থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে আরো রূপসী দেখায়, কারণ টংলু প্রায় নির্জন। আর এখন আমরা লাফালাফি করছি, বরফ নিয়ে খেলছি আর ছবি তুলছি।

হটাৎই আমাদের গাইডসাহেব আমাদের শান্ত হতে বললেন আর হাতের ইশারাতে দেখালেন শায়িত বুদ্ধ বা স্লিপিং বুদ্ধকে। কাঞ্চনজঙ্ঘাকে মাঝখানে রেখে পান্ডিম, সিম্ভর মতো অন্য পর্বতশৃঙ্গগুলো এক অন্যন্য রূপদান করেছে। যেটা দেখে আপনার মনে হবে কেউ শুয়ে আছে। স্থানীয়রা একেই স্লিপিং বুদ্ধ বা শায়িত বুদ্ধ বলে মেনে চলেন। সেইবার খুব ভালো ছবি ওঠেনি স্লিপিং বুদ্ধের, তাও একটা ছবি দিলাম। ছবির খারাপ কোয়ালিটির জন্যে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। ভালো করে দেখুন, মাথা, গলা, পেট, পা সব বুঝতে পারবেন। আর এই পুরো রেঞ্জটার মধ্যে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের প্রিয় কাঞ্চনজঙ্ঘা।
এখানকার স্থানীয় মানুষরা শায়িত বুদ্ধকে খুব মেনে চলেন। বছরের পর বছর কাঞ্চনজঙ্ঘাকে মাঝখানে রেখে হিমালয়ের এই অনন্য রূপ মোহিত করে রেখেছে এখানকার জানজাতিকে, তাদের অটুট বিশ্বাস আজ তৈরী করেছে এই শায়িত বুদ্ধ বা স্লিপিং বুদ্ধকে। যে স্থানীয় মানুষদের সাথে, আমাদের মতো পায়ের তলায় সর্ষে লাগানো বা না লাগানো পর্যটকদের সমান ভাবে মোহিত করে রেখেছে। আপনি দার্জিলিঙের টাইগার হিল বা অন্য আরো জায়গা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখতে পারেন, কিন্তু এই শায়িত বুদ্ধের রূপ দেখতে হলে, আপনাকে একবার আসতেই হবে সান্দাকফু রুটে। একবার আসুন এখানে, তুমলিং, টংলু অথবা সান্দাকফুর সুবিশাল তৃণভূমির ওপর বসে তাকিয়ে থাকুন স্লিপিং বুদ্ধের দিকে, কথা দিচ্ছি আপনি নির্জনতার বিরল সুর অবশ্যই শুনতে পারবেন। স্লিপিং বুদ্ধের দিকে তাকিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা যে কি করে আপনার কেটে যাবে, তা বুঝতে পারবেন না।
এখন থেকে আর ফিরতে ইচ্ছে করছিলো না, কিন্তু কি করা যাবে, ফিরতে তো হবে। ফেরার সময় আর কষ্ট হয়নি, বেশ তাড়াতাড়িই নেমেছিলাম মানেভঞ্জন। লেগেছিলো মাত্র ৫ ঘন্টা। সাত বছর পর, ২০১৩ তে স্ত্রী ও জ্যেষ্ঠপুত্রকে নিয়ে আবার গিয়েছিলাম শায়িত বুদ্ধকে দেখতে। তবে এবার তুমলিং নয়, তাকে দেখেছিলাম টংলু থেকে। সেই গল্প আপাতত তোলা থাক। পরে বলবো।

Bholanath Roychowdhury
Porlay monay hoy, ekbaar jaabo….