বর্গী এসেছিলো দেশে…

খোকা ঘুমালো, পাড়া জুড়োলো
বর্গী এলো দেশে…

ছড়াটা আমরা ছোট বড় সবাই প্রায় জানি। কিন্তু কোনোদিন আমরা খুঁজে দেখেছি এই ছড়ার মধ্যে লুকিয়ে থাকা বেদনাকে? সময়টা ছিল ১৭৪০ থেকে ১৭৫০ এর মধ্যে। সেই দশটা বছর পালা করে বর্গীরা অথবা মারাঠারা প্রবল লুঠতরাজ চালিয়েছিল বাংলার পশ্চিমভাগে। বর্গীদের আক্রমণে হারিয়ে যাওয়া তেমনি এক জায়গা গড়পঞ্চকোট, যে আজ নীরবে মারাঠা আক্রমনের ক্ষতচিহ্ন বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

Watch Tower

গড়-পঞ্চ-কোট

বাংলায় “গড়” শব্দের অর্থ দুর্গ, ‘পঞ্চ’ মানে পাঁচ এবং আর ‘কোট’ মানে গোষ্ঠী।

একটু ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকানো যাক। রাজা দামোদর শেখর, সম্ভবত ৯০ খ্রিস্টাব্দের প্রথমদিকে ঝালদা অঞ্চলের পাঁচজন সর্দারের সহায়তায় পঞ্চকোটরাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং আরও বেশ কয়েকটি পরগনার উপর তাঁর রাজত্ব প্রসারিত করেছিলেন। স্থানীয়দের প্রধান পাঁচটি গোষ্ঠীকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য রাজ্যটির নাম হয় পঞ্চকোট। গড়পঞ্চকোট আসলে পাঞ্চেত পাহাড়ের কোলে পরিখা দিয়ে ঘেরা এক প্রকান্ড দুর্গ। দুর্ভাগ্যের বিষয়, আজ সে অবহেলার শিকার। পুরাতন স্থাপত্যগুলোর কিছু অংশ বর্তমানে সংস্কার হয়েছে, কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় অতি সামান্য।

কলকাতা থেকে দূরত্ব: ২৪৬ কিমি

নিকটবর্তী রেলওয়ে স্টেশন: বরাকর বা কুমারডুবি। আদ্রা বা আসানসোল নেমেও যেতে পারেন।

কংক্রিটের জঙ্গল ছাড়িয়ে করোনা আবহেই রওনা দিয়েছিলাম সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২১০৯ ফিট উচ্চতার গড়পঞ্চকোটে, প্রায় ৭ বছর পর। তবে এটা এখানে আমার দ্বিতীয় ভ্রমণ নয়। এবার নিয়ে চতুর্থবার। প্রথমবার গিয়েছিলাম ২০০৮ এ।

দুর্গাপুর এক্সপ্রেস ধরে আসানসোল, দিশেরগড় হয়ে আমাদের আজকের গন্তব্য গড়পঞ্চকোটে পশ্চিমবঙ্গ বনদপ্তরের প্রকৃতি ভ্রমণ কেন্দ্র। পুরুলিয়া বরাবরই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর, দিশেরগড় ব্রিজ পেরিয়ে পুরুলিয়াতে প্রবেশ করেই সেটা ভালো করে বুঝতে পারবেন। আর একটু এগোলেই গড়পঞ্চকোটের বনবাংলো।

দিশেরগড় থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার। এই দশ কিলোমিটারের পথশোভা দুর্দান্ত। শাল পিয়ালে ভরা বাঘমারা জঙ্গল দিয়ে বেশ কিছুটা গেলেই বাম হাতে পড়বে প্রকৃতি ভ্রমণ কেন্দ্র। নিতুরিয়া – বাঘমারার জঙ্গল বায়োডাইভার্সিটির জন্যে বিখ্যাত। নেমে পড়ুন জঙ্গলে, বন বাংলো অবধি বাকি পথটা হেঁটেই যান। নামে বাঘমারার জঙ্গল হলেও, এখানে কাঠবিড়ালীর চেয়ে বড় প্রাণী দেখার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ভয় নেই, এখানকার ত্রিসীমানায় বাঘ নেই।

কোথায় থাকবেন: পশ্চিমবঙ্গ বনদপ্তরের প্রকৃতি ভ্রমণ কেন্দ্র অথবা পাঞ্চেত রেসিডেন্সি

এছাড়াও গড়পঞ্চকোটে আরো অনেক ইকো রিসর্ট পাবেন, ইন্টারনেট ঘেটে তাদের ঠিকানা পেয়ে যাবেন

বনদপ্তরের সাধারণ সুবিধাযুক্ত কটেজগুলো থাকার জন্যে মন্দ নয়, বিশেষ করে রাত্রিবেলায় ঝিঝি পোকার ডাক শুনতে শুনতে ক্যাম্পাসে ঘুরতে আপনার বেশ লাগবে। তবে যদি আপনি গড়পঞ্চকোটে আধুনিক সুযোগসুবিধাসহ মডার্ন জায়গাতে থাকতে চান, তবে জঙ্গল শুরুর আগে বাম হাতে পাঞ্চেত রেসিডেন্সিতে থাকতে পারেন।

Pancharatna Temple
এখানকার গড়পঞ্চকোটের পঞ্চরত্ন মন্দির

দুপুরটা কটেজে কাটিয়ে আমরা বেড়িয়ে পড়লাম গড়ের উদ্দেশ্যে। কিন্তু গড়ে ঢুকেই মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেলো, চারপাশে এতো দোকান কেন? দূরে একটা ওয়াচ টাওয়ার, তার গায়ে জঙ্গল সাফ করে উঁকি দিচ্ছে এক পেল্লাই সরকারী বাংলো। দেখলাম মন্দিরের চারপাশ একটা খুব খারাপ দেখতে লাগা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। সত্যি বলতে, যেবার প্রথম গড়পঞ্চকোটে এসেছিলাম, সেবার দেখে মনে হয়েছিল, গড়পঞ্চকোটের প্রাণ আছে। এ আমাদের কিছু বলতে চায়। মানছি মন্দিরের সংস্কার দরকার ছিল, কিন্তু এ কি সংস্কার? বারবার মনে হয়েছে সংস্কারের ফাঁকে গড়পঞ্চকোট আজ প্রাণত্যাগ করেছে। এটা অবশ্য আমার একান্ত ব্যক্তিগত মতামত। হয়তো যা হয়েছে, তা প্রশংসাযোগ্য।

অন্যদিকে এটাও ঠিক, মন্দিরটা বছরের পর বছর যেভাবে ভেঙে পড়ছিলো, সংস্কার করা ছাড়া আর উপায়ও ছিল না। তবুও, আমরা কি পারতাম না রোমের কলোসিয়াম বা নিদেনপক্ষে কোনার্কের সূর্য মন্দিরের মতো একে সংরক্ষণ করতে? কি জানি।

বর্তমানে পঞ্চরত্ন মন্দির এবং প্রহরীদের একখানা ওয়াচ টাওয়ার ছাড়া অন্যান্য কোনো স্থাপত্যের কোনো সংরক্ষন হচ্ছে না, যেটা বড্ড চোখে লাগে। জোড়বাংলা মন্দির, রানীমহল থেকে সেনা ছাউনি, রাজপ্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ ও কর্মচারীদের বাসস্থান প্রত্যেকটা ইতিহাস অনাদরে নষ্ট হচ্ছে।

Panchet Hill
পাঞ্চেত পাহাড়

গড়পঞ্চকোটের প্রতিটা ইঁটের সংরক্ষণ প্রয়োজন সম্পূর্ণ পুরাতাত্বিক উপায়ে, নাহলে বর্গী আক্রমণের নীরব সাক্ষী অচিরেই প্রাণ হারাবে।

মনটা খুব ভারী হয়ে গিয়েছিলো, তাই খুব বেশি ছবি তুলিনি।

প্রকৃতি আর ইতিহাসের হাত ধরাধরি করে সপ্তাহের শেষটা এবারের মতো কাটিয়ে আসতেই পারেন গড়পঞ্চকোটে। বেশি দেরি করলে, প্রকৃতি ও ইতিহাসের মেলবন্ধন আর হয়তো দেখতে পাবেন না।

পরের দিন ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে আমরা গিয়েছিলাম জয়চন্ডী পাহাড় আর মুরুগুমার উদ্দেশ্যে। ওরা আমাদের নিরাশ করেনি।