ছবির মতো মুরুগুমা

বাহ্, বাহ্ , বাহ্ … মুরুগুমাকে প্রথমবার দেখে এই শব্দবন্ধই মুখ থেকে বেরিয়েছিল। লকডাউনের পর খোলা আকাশে প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে বেরিয়ে পড়েছিলাম পুরুলিয়ার উদ্দেশ্যে। একটুও নিরাশ করেনি পুরুলিয়া, যা ভেবেছিলাম তার চেয়ে ঢের বেশি পেয়েছি। বিশেষ করে মুরুগুমাতে। এবারও যে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল তা নয়, আসলে আমরা ভেবেছিলাম গড়পঞ্চকোট আর বড়ন্তি যাবো। গড়পঞ্চকোটে ঘর পাওয়া গেলেও বড়ন্তিতে পাইনি। তাই মনটা প্রথমে একটু খারাপই হয়েছিল। কিন্তু একটা লেকের অথবা ড্যামের পাশে থাকতে হবে। তাই মাথায় ঘুরঘুর করছিলো অল্টারনেটিভ হিসেবে তিনটে নাম: খয়রাবেরা, মুকুটমণিপুর আর মুরুগুমা। ইন্টারনেটে প্রচুর পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানোর পর ঠিক করলাম, এবার যাবো মুরুগুমা। যা হওয়ার হবে।
গড়পঞ্চকোট থেকে শুরু হয়েছিল যাত্রা। প্রথমে জয়চন্ডী পাহাড় দেখে, রওনা দিলাম মুরুগুমার উদ্দেশ্যে। আজ গল্প বলবো মুরুগুমার, গড়পঞ্চকোটের গল্পটা পরের সংখ্যাতে বলা যাবে।
কলকাতা থেকে দূরত্ব: ৩২৩ কিমি
নিকটবর্তী রেলওয়ে স্টেশন: ঝালদা অথবা বেগুনকোদর

বাই বাই স্ফীঙস!
সকালবেলা জয়চন্ডী পাহাড় ও বাঙালি স্ফীঙসকে বাই বাই করে গুগল ম্যাপে লোকেশন সেট করলাম মুরুগুমা। কিন্তু কে জানতো, “ফ্যারাওয়ের অভিশাপ” এখানে কাজ করে যাবে। অভিশাপটা যে কি সেটা আর একটু পরেই বুঝতে পারবেন।
যাই হোক, গুগল ম্যাপকে বেদবাক্য মেনে এগোতে লাগলাম মুরুগুমার পথে। কিন্তু বেশ কয়েকঘন্টা ড্রাইভ করার পর বুঝতে পারলাম, গুগল ম্যাপ পুরুলিয়াতে অথর্ব বেদ মেনে চলে। ধরতে পারলেন না তো!! আচ্ছা, একটা উদাহরণ দিচ্ছি, ধরুন আপনি ডানলপ থেকে যাবেন শ্যামবাজার, কিন্তু আপনাকে শ্যামবাজার যেতে হলো বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে ধরে এয়ারপোর্ট – সেক্টর ফাইভ হয়ে।
মাঠা পাহাড় ইচাগ থেকে ঝালদা যাওয়ার রাস্তায় নাম না জানা পাহাড়
ঠিক একইরকম ব্যাপার আমাদের সাথে ঘটেছিলো, প্রায় ৮০ কিমি এক্সট্রা গাড়ি চালিয়ে পৌঁছেছিলাম মুরুগুমা। এটাকে “ফ্যারাওয়ের অভিশাপ” ছাড়া আর কি বলবো? তাও রাস্তার ধারে চোখধাঁধানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর অযোধ্যা পাহাড় ছিল বলে রক্ষা। তবে মার্চ মাসে এই রাস্তাটা বেশ লাগবে, যখন পলাশ গাছগুলো লাল হয়ে যাবে। বলরামপুর, মাঠাবুরু, বাঘমুন্ডি, ঝালদা হয়ে প্রচুর ঘুরে পৌঁছলাম বেগুনকোদর। যাত্রাপথ বেশ লম্বা হলেও বিশেষ একটা বোরিং লাগেনি। আরেকটা কথা, ইচাগ থেকে ঝালদা এইটুকু রাস্তা দারুন সুন্দর।

যাই হোক, বেগুনকোদর বাজার হয়ে ঢুকে পড়লাম মুরুগুমার স্বপ্নরাজ্যে। প্রথম দর্শনেই মন জিতে নিলো মুরুগুমা। সত্যি, মুরুগুমাকে ছবির মতো বললে কম বলা হয়।
কোথায় থাকবেন: বনপলাশী ইকো হাট অথবা পলাশবিতান জঙ্গল হাট
দুটোই পাশাপাশি আর একই রকম সুযোগসুবিধা, পছন্দমতো বেছে নিন
ক্যামেরাবন্দী রূপসী মুরুগুমা বনপলাশী ইকো হাটে পৌছালাম
এতক্ষণ জার্নি করে খুব কাহিল হয়ে পড়েছিলাম, কিন্তু রিচার্জড হয়ে গেলাম আর এক টুরিস্ট পার্টির গল্প শুনে। আমরাতো তাও গুগলের সৌজন্যে পুরুলিয়া জেলার চক্কর কাটছিলাম, ওদের নাকি গুগল রাঁচি ঘুরিয়ে নিয়ে এসেছে। আমরা ছিলাম বনপলাশী ইকো হাটে। মুরুগুমাতে থাকার ঠিকঠাক বন্দোবস্ত দুইখানা, একটা বনপলাশী আর একটা পলাশবিতান। দুটোই পাশাপাশি।
খাটিয়াতে বসে ঘরোয়া আসর সুস্বাদু বাম্বু চিকেন
প্রায় সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছিলো পৌঁছতে পৌঁছতে। তাই বিশেষ আর কিছু করার ছিল না সেদিন। কিন্তু কিছু না করে কি আর থাকা যায়। সেপ্টেম্বরের সন্ধ্যায় যেই শিশির ভিজিয়ে দিলো আমাদের ইকো হাটের ঘাসগুলোকে, তখনই বাম্বু চিকেন বলে দিলাম … আসর জমে গেলো। তারপর ডিনার সেরে বিছানায় ফ্ল্যাট, সকালে উঠতে হবে তো!
অনেকদিন বাদে ভোরবেলায় ঘুম ভাঙলো মোরগের ডাকে, উঠেই ছুটলাম আমাদের রিসর্টের গেটের দিকে, গেট পেরোলেই মুরুগুমা। ছোট ছোট পাহাড়ে আর জঙ্গলে ঘেরা সুবিশাল ড্যাম। মেঠো পথ ধরে দুই ছেলেকে নিয়ে হাটতে লাগলাম, সামনের অনতিউচ্চ টিলার দিকে, একটা ছোট্ট ব্রিজ আছে, ওটা পেরোলেই আর একটা ভিউ পয়েন্ট। তারপর আরেকটা, আরেকটা করে অনেকগুলো। সবকটা জায়গা থেকে আলাদা আলাদা রূপে ধরা দেয় মুরুগুমা।

তিন বছর বাদে নাকি ড্যাম জলে পরিপূর্ণ হয়েছে, তাই বাঁধের থেকে জল উপচে পড়ছে। বুকে বল থাকলে, ওখানে গিয়ে বাঁধের জলে স্নানও করতে পারেন। তবে আবশ্যই আপনার হোটেলের কোনো কর্মচারীর তত্ত্বাবধানে। সাবধানের মার নেই। তবে আবার মোহিত হয়ে, ইউরেকা ইউরেকা কান্ড ঘটিয়ে ফেলবেন না যেন।










মুরুগুমা ও তার আসেপাশের জায়গাগুলো খুব সুন্দর, হাতে সময় ছিল না বলে, এবার খুব বেশি ঘুরতে পারিনি। তবে সামনের বসন্তে আবার যাবো, অন্তত দুইদিন থাকতে হবে। পলাশের রঙে রাঙানো মুরুগুমার আসল রূপ নাহলে দেখবো কি করে।
সকালে এদিক ওদিক একটু ঘুরে ব্রেকফাস্ট সেরে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। বসন্ত এসে গেলেই ফিরবো, কথা দিলাম মুরুগুমা।

কিভাবে যাবেন?
কলকাতা থেকে দুর্গাপুর, বাঁকুড়া হয়ে পুরুলিয়া ডি.এম বাংলো, তারপর তামনা মোড়, বেগুনকোদর বাজার হয়ে মুরুগুমা।
যাহ, গড়পঞ্চকোটের গল্প তো বলাই হলো না। ঠিক আছে, আর কটাদিন বাদেই না হয় বলবো।
এখন ফোকাস টু ওয়ার্ক ফ্রম হোম।
Ayan Bhattacharjee
?
বেশ ভালো লাগলো। তবে আরও একটু তথ্য যুক্ত করলে এক ছাদের নিচে সবটাই পাওয়া হয়ে যেত ?
শিবাজী
সুন্দর প্রাঞ্জল লেখা, দারুন সুখপাঠ্য, এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম, খুব তাড়াতাড়ি যাব।
ভালো থাকবেন।