স্ফীঙসের আপন দেশে

উফ্ফ, আর পারা যাচ্ছিলো না। লকডাউনে বাড়ি বসে থাকতে থাকতে কেমন যেন মিইয়ে যাচ্ছিলাম। তাই একদিন ঘুম থেকে উঠে ঠিক করে ফেললাম, এবার বাড়ির বাইরে বেরোতে হবে। ব্যাস, বেরিয়ে পড়লাম। গাড়িটা নিয়ে চললাম স্ফীঙসের আপন দেশে।
চমকে উঠলেন নাকি মশাই!!! আরে মিশরের নয়, যাচ্ছি বাঙালি স্ফীঙসের দেশে।
আমি তো গিয়েছিলাম গাড়ি নিয়ে, যদি আপনার কাছে নিজস্ব গাড়ি না থাকে তবে হাওড়া থেকে ট্রেন ধরে সোজা চলে আসুন আদ্রা (যদিও এই জায়গার সবচেয়ে কাছের স্টেশন জয়চন্ডী পাহাড়, কিন্তু হাওড়া থেকে এই স্টেশনে ট্রেন আসেনা । তারপর টোটো ধরে মিনিট পনেরোর পথ।
কলকাতা থেকে দূরত্ব: ২৫৩ কিমি
নিকটবর্তী রেলওয়ে স্টেশন: জয়চন্ডী পাহাড় অথবা আদ্রা জংশন
যাইহোক, একটু পিছিয়ে গিয়ে শুরু করি।
সক্কাল সক্কাল যাত্রা শুরু করে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে সাই সাই করে চলে এলাম দুর্গাপুর , তারপর বায়ে বেঁকে বড়জোড়া, গঙ্গাজলঘাটি হয়ে সোজা জয়চন্ডী পাহাড়ের পাদদেশে।

দুর্গাপুরে দামোদর পেরিয়ে আসল সৌন্দর্য শুরু হলো, শরৎকালে রাস্তার পাশটা পুরো কাশফুলে ভরে গেছে। আনন্দে আমি আর গিন্নি নেমে পড়লাম গাড়ি থেকে, কাশফুল তুলতে। তারপর আবার পথ পাড়ি। মোটামুটি ২৫০ কিলোমিটার গাড়ি চালিয়ে পৌঁছলাম জয়চন্ডী পাহাড়।
জয়চন্ডী পাহাড়ের সামনে একটা পেল্লাই মাঠ, আর সেখানে ছেলেরা ফুটবল খেলছে আর সেই খেলা দেখছে স্বয়ং স্ফীঙস। বিশ্বাস হচ্ছে না? দেখুন স্ফীঙস স্ফীঙস লাগছে কিনা।

মাঠের সামনে দিয়ে ছোট ছোট টিলাগুলোকে দারুন লাগে। জয়চন্ডী পাহাড় ছোটনাগপুর মালভূমির একটা অংশ, যেমনটা অযোধ্যা পাহাড়। স্থানীয়রা বলে থাকে এগুলো নাকি সুপ্ত আগ্নেয়গিরি, কিন্তু এগুলো একদমই তা নয়। এগুলো রেসিডুয়াল হিল, বাংলায় কি বলে ভুলে গেছি, জানতে চাইলে আমার ভূগোলের শিক্ষক শুদ্ধসত্ত্ব ভট্টাচার্যকে জিজ্ঞাসা করে নেবেন।
যুগাঢাল পাহাড় অথবা বাঙালি স্ফীঙস জয়চন্ডী পাহাড় ও কালীপাহাড়
মূলত তিনটে পাহাড় এখানে, যুগাঢাল (যাকে আমি স্ফীঙস বলেছি), জয়চন্ডী আর কালীপাহাড়। তারমধ্যে সবথেকে উঁচু পাহাড় যুগাঢালে মাউন্টেনারিং করার ব্যাবস্থা আছে (কালীপাহাড়েও করা যায় মনেহয়, জিজ্ঞেস করিনি)। চাইলে শীতকালে চেষ্টা করতেই পারেন, কিন্তু আমার কোনোকালেই সম্ভব নয়। আমার পক্ষে সিঁড়িটাই ঠিক। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে পারবেন জয়চন্ডী পাহাড়ে। যুগাঢালের ঠিক পাশের পাহাড়। সেপ্টেম্বরে একটু গরম থাকলেও, অসুবিধা হয় না। মানে আমি ১১০ কেজি শরীরটা নিয়ে যখন উঠতে পেরেছি , আপনারাও পারবেন। চলুন শুরু করি সিঁড়ি ভাঙা।

জানেন তো, জয়চন্ডীতে ওঠার সিঁড়িগুলো বেশ ভালো। প্রায় ৫০০ সিঁড়ি হলেও, খুব ছোট ছোট ধাপ আর মাঝে মাঝেই বসার জায়গা, তাই চারবারের বেশি আমায় দাঁড়াতে হয়নি। পাহাড়ি জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সিঁড়ি, কিছুটা ওঠার পর বেশ রোমাঞ্চকর লাগে। প্রায় ৩৫০ সিঁড়ি পেরোলে পাবেন এক ভগ্নপ্রায় শিমাফোর টাওয়ার। আগে যদি না দেখেন এইটা আপনার কাছে একটা দারুন প্রাপ্তি।
আসলে শিমাফোর টাওয়ারের ব্যবহার ছিল টেলিগ্রাম-টেলিফোন জামানার আগে। এগুলি মূলত তৈরি হয়েছিল মারাঠা বা বর্গী অনুপ্রবেশকে নজরবন্দী করার জন্যে। এরকম টাওয়ার পর পর থাকতো, আর যখনই কেউ টাওয়ারে দেখতেন দূর থেকে বর্গীরা আসছে, তখনি এর মাথায় লাগানো একটা শাটারকে সোজা করে দিতেন, তা থেকে পরের টাওয়ারে সিগন্যাল চলে যেত যে, বর্গীরা আসছে। ওই দেখে অন্য গ্রামগুলো সজাগ হয়ে যেত। পুরুলিয়া, বাঁকুড়া ও হুগলিতে এখনো অনেক ভগ্নপ্রায় শিমাফোর টাওয়ারের খোঁজ মেলে। এগুলোর সত্যি এখন মেরামতির প্রয়োজন, নাহলে কালের অলিন্দে ইতিহাসটাই হারিয়ে যেতে পারে।
পাহাড়ে ওঠার সিঁড়ির পাশে ভগ্নপ্রায় শিমাফোর টাওয়ার জয়চন্ডী পাহাড়ের সিঁড়ি থেকে শিমাফোর টাওয়ার এবং কালীপাহাড়
শিমাফোর টাওয়ারের থেকে ১০-১৫ টা সিঁড়ি চড়লেই জয়চন্ডী পাহাড়ের ওপরের হনূমান মন্দিরটা দেখতে পাবেন। কাছেই যখন এসে গেছি দেরি না করে উঠে পড়া যাক।
বাহ্! জয়চন্ডী পাহাড়ের ওপরটা তো দারুন, অসাধারণ লাগছে রঘুনাথপুরকে। সামনে যুগাঢাল আর পিছনে কালীপাহাড়ও সমান ভালো। বলে রাখা ভালো, এখানে কিন্তু “হীরক রাজার দেশে” ছবির শুটিং হয়েছিল। পাহাড়ের ওপরে দুটো মন্দির আছে, একটা জয়চন্ডী মন্দির, আরেকটা হনূমান মন্দির। ইচ্ছে হলে পুজো দিতে পারেন। কিন্তু পাহাড়ের ওপর থেকে চারদিকের মনোরম দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করতে ভুলবেন না।

জয়চন্ডী পাহাড়ের ওপর থেকে রঘুনাথপুর
যাবেন নাকি একবার? ঘুরেই আসুন।
এরপর বেশ তাড়াতাড়িই নামলাম পাহাড় থেকে। নামতে নামতে দেখলাম, আমার অর্দ্ধেক চেহারার একটা ছেলে সিঁড়িতে বসে হাফাচ্ছে, আর তার বন্ধুদের বলছে, “আমি আর পারবো না”। দৌড়ে গিয়ে বললাম, “ভাই আমার চেহারাটা দেখো আর চটপট উঠে পড়ো, নাহলে পরে আফসোস করবে”।
Prasanta Das
Really awesome. I enjoyed vey much the Bengali Sphinx. I will have a wish to go there. Please write more blogs like this. The travel minded bengal will surely enjoy places like this.
Debashis Mandal
সেকি .. জয়চন্ডী পাহাড় দেখতে দেখতে একটা স্মল হিল এর উপর একটা রেস্তরায় বসে পড়ন্ত বিকেলে লাঞ্চ করলাম .. ভুলে গেলে ??
Dhruba Jyoti Moitra
দারুন লেখা, পরিপাটি ওয়েবসাইট | অনেক শুভেচ্ছা রইলো |
Narendra modi
Mitro.. khub e sundor jayga.. dekhe amar o jete ichhe korche
Arghya Roy
সুজয় খুব ভালো লাগল। ভাই প্রশান্ত সেবারে অনেক কিছু বাকি থেকে গেছে। তাহলে হোক আর ও একবার।